তিনি স্ব-ঘোষিত লেখক, সাংবাদিক, মিডিয়া ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবীদ, সমাজসেবী, মানবাধিকারকর্মী, ও সংগঠক। যখন যেখানে যে পরিচয় দিলে সুবিধা সেখানে তিনি সেই পরিচয় দিয়ে দাঁপিয়ে বেড়াতেন। সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে তিনি নামে বেনামে অসংখ্য আইডি করেছেন। নিজেকে বড় লোক জাহির করতে একাই ফেসবুকে পেইজ ও আইডি খুলে করেছেন অসংখ্য সংগঠন ও ক্লাব। এসব আইডি ও পেইজ থেকে সময়ে সময়ে নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে কমেন্ট, পোস্ট ও শেয়ার করতেন।নামি বেনামি এ সকল আইডি ও পেইজ থেকে সময়ে সময়ে অনেক ব্যক্তি ও পরিবার ছাড়াও তার অপছন্দের ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও কুৎসা রটাতেন। উপজেলা প্রশাসন ও থানায় নতুন কর্মকর্তা আসলে সাংবাদিক পরিচয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে তিনি দৌড়ে চলে যেতেন। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তা ছাড়াও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এমনকি এমপি-মন্ত্রীকে সামনে পেলে সাংবাদিক পরিচয়ে পাঁশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলে ফেসবুকে প্রচার করা ছিল তার মূল টার্গেট। আর সাধারণ মানুষ কোন বিপদ-আপদ কিংবা সমস্যায় পড়লে এসব দেখিয়ে বিভিন্ন অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ফাঁয়দা হাছিল করাই ছিল একমাত্র কাজ।
সেই ধারাবাহিকতায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারি জকিগঞ্জ থানায় যোগদানকৃত নবাগত অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোশাররফ হোসেন-এর সাথে তার চক্রের ৪/৫ জন লোক নিয়ে সৌজন্য সাক্ষাতে ওসি’র কক্ষে মিলিত হন। অথচ তিনি একটি চাঁদাবাজি মামলার জেলা ও দায়রা জজ আদালত কর্তৃক পলাতক আসামী! অর্থ মামলায়ও আদালত থেকে ৬ মাসের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী। কিন্তু তিনি নিজকে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বুঝাতে নবাগত অফিসার ইনচার্জ-এর সাথে সাংবাদিক পরিচয়ে সাক্ষাৎ করে ছবি তুলে ফেসবুকে ছড়িয়ে দেন। নতুন ওসি সাংবাদিক পরিচয় শুনে যথাযথ আদর আপ্যয়ন করলে সুযোগে ওরা নিজেকে জাহির করতে মিষ্টি ও নাস্তার ছবি তোলে ফেসবুকে প্রচার করেন।
অপরদিকে একজন ওয়ারেন্টভুক্ত আসামীকে ওসি’র সাথে এমন অন্তরঙ্গ ভাবে দেখে অবাক হয়ে যান চাঁদাবাজি মামলার বাদী আবুল হারিছ। তিনি স্থানীয় সাংবাদিকদের বিষয়টি অবগত করলে নড়েচড়ে বসেন সাংবাদিকরা। এরিমধ্যে সিলেটে কর্মরত বিভিন্ন গণমাধ্যম কর্মীদের বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে “জকিগঞ্জে ওয়ারেন্টভুক্ত আসামীকে নিয়ে ওসি’র আড্ডা” শিরোনামে একাধিক স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হয়। এমন একটি সংবাদে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন নবাগত ওসি মোঃ মোশাররফ হোসেন। পুলিশের এমন ভূমিকা নিয়ে সর্বত্র তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
এমনি প্রেক্ষাপটে জকিগঞ্জ থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোশাররফ হোসেন ওয়ারেন্টভূক্ত আসামী এটিএম ফয়ছল আহমদকে ধরতে তৎপর হয়ে উঠেন। সিলেট জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে সর্বশেষ সিলেট নগরী থেকে মঙ্গলবার বিকালে তাকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করে জকিগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোশাররফ হোসেন বলেন, সে ওয়ারেন্ট হওয়ার আগে আমার সাথে সাংবাদিক পরিচয়ে দেখা করেছে। সে ওয়ারেন্টভূক্ত আসামী জানতে পেরে জকিগঞ্জ থানা পুলিশের একটি দল নিরলসভাবে তাৎক্ষণিক অভিযান চালিয়ে গ্রেফতার করে আদালতের মাধ্যমে জেল হাজতে পাঠিয়েছে। ওসি আরোও বলেন, আইন সবার জন্য সমান। আইনের উর্ধ্বে কেউ নয়। অপরাধী যেই হোক আমরা গ্রেফতার করবোই।
জানা যায়, সাংবাদিক পরিচয়ধারী এটিএম ফয়ছল আহমদ জকিগঞ্জ উপজেলার ৯নং মানিকপুর ইউনিয়ন-এর ৪নং ওয়ার্ডের অন্তর্গত দরগাবাহারপুর গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ২০১৮ সালে তার একই গ্রামের বাসিন্দা মুহিউদ্দীন (মহসিন) আত্মহত্যার ঘটনায় জকিগঞ্জ পৌর এলাকার বাসিন্দা ও জকিগঞ্জ বাজারের কুশিয়ারা রোডে অবস্থিত শরিফ ট্রেডার্স-এর সত্বাধিকারী মৃত মহসিন-এর তালতো ভাই আবুল হারিছ-এর নিকট চাঁদা দাবীর অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে এটিএম ফয়ছল আহমদকে আসামী করে জকিগঞ্জ থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী আবুল হারিছ। চাঁদাবাজির অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে সত্যতা পেয়ে মামলা হিসাবে তা রেকর্ড করে। জকিগঞ্জ থানার মামলা নং ০২, তারিখ- ১০/১১/২০১৮ খ্রিস্টাব্দ।
সেই মামলায় এটিএম ফয়ছল আহমদ দীর্ঘদিন থেকে নানা কৌশলে আদালত থেকে জামিনে ছিল। দীর্ঘ দুই বছর পর সিলেটের অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতের বিজ্ঞ বিচারক গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেন। সেই গ্রেফতারী পরোয়ানা মাথায় নিয়েই নিজেকে অধিক ক্ষমতাসীন বুঝাতে তিনি এলাকায় দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি নবাগত অফিসার ইনচার্জ মোঃ মোশাররফ হোসেনকে বিতর্কিত করে জকিগঞ্জ থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে এটিএম ফয়ছল আহমদ গ্রেফতারের খবর পেয়ে একাধিক ভূক্তভোগী তাদেরকে হয়রানী করার বিষয়টি প্রকাশ করতে শুরু করেছেন। কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের বিস্তর অভিযোগ তুলেছেন। রূপালী ব্যাংক জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজার শাখা থেকে জাল ডকুমেন্ট দিয়ে ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা ঋণ উত্তোলনের অভিযোগ করেছেন ব্যাংক ম্যানেজার লিটন কুমার ধর। তিনি বলেন, জেলা ও দায়রা জজ ৩য় আদালত কর্তৃক (দায়রা-৩১৭/১৭) মামলায় তাকে ৬ মাসের কারাদন্ড ও নগদ অর্থদন্ড প্রদান করেন ২০১৭ সালের ২৫ মে।তার বিরুদ্ধে ব্যাংকের করা মামলায় আদালতের রায়ে ৬মাসের কারাদন্ড ও ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হলেও সে দীর্ঘদিন থেকে সাংবাদিক পরিচয়ে ঘুরে বেড়াতো।
স্থানীয়রা জানান, বিভিন্ন পরিচয় দিয়ে দাঁপিয়ে বেড়ানো এই এটিএম ফয়ছল আহমদ বিভিন্ন সময়ে নিজেকে জকিগঞ্জ উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি ও জকিগঞ্জ উপজেলা অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি পরিচয় দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছিল। সে সিলেট জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফরিদ উদ্দিন পিপিএম মহোদয়ের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচয় দিতো। এছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন, জকিগঞ্জ সার্কেল ও জকিগঞ্জ থানায় যখন যা বলবে তা হবে বলে নিজেকে এলাকায় উপস্থাপন করতো।
এ প্রসঙ্গে জকিগঞ্জে কর্মরত সাংবাদিকরা জানান, এটি এম ফয়ছল আহমদ সাংবাদিকদের কোন ক্লাবের সভাপতি দূরে থাক, সে যে সাংবাদিক তা তাদের কারোও জানা নেই। সে জকিগঞ্জ প্রেসক্লাব বা জকিগঞ্জ অনলাইন প্রেসক্লাবের কেউ নয়। বরং সাংবাদিক পরিচয়ে তার নানা অপকর্মে বিব্রত ও অতিষ্ঠ জকিগঞ্জের সংবাদকর্মীরা।
চাঁদাবাজী মামলার বাদী আবুল হারিছ বলেন, তার তালতো ভাই মাওলানা মুহিউদ্দিন মহসিনের লাশ দাফনের আগে প্রতারক এটিএম ফয়ছল আহমদ তাকে ২০ হাজার টাকা চাঁদা না দিলে সে লেখালেখি করে আমাকে হত্যা মামলায় জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। আমি তাকে তার দাবীকৃত চাঁদা না দেয়ায় সে আমার উপর বিভিন্নভাবে চাঁপ সৃষ্টি করে। তখন আমি উপায়ন্তর হয়ে জকিগঞ্জ থানা পুলিশের আশ্রয় নিলে এবং লিখত অভিযোগ করলে পুলিশ তদন্ত সাপেক্ষে সত্যতা পেয়ে তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা রেকর্ড করে। একটি অপমৃত্যুর ঘটনায় সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদা আদায়ের চেষ্ঠাকারী সেই কথিত সাংবাদিক ফয়ছলের তিনি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবী জানান।
Leave a Reply