ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পেরিয়ে গেলেও স্বনামে ফিরেনি সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ‘মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি’! এখনো সরকারি ওয়েবসাইট ও অফিসিয়াল ডকুমেন্টে কানাইঘাট-জকিগঞ্জের জনপ্রিয় নেতা প্রয়াত বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল হারিছ চৌধুরীর নাম বাদ দিয়ে ‘মুলাগুল উচ্চ বিদ্যালয়’ নামে কার্যক্রম চলছে। প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব প্রয়াত আবুল হারিছ চৌধুরীর নাম থাকার অপরাধে চাঁপ প্রয়োগ করে অন্যায়ভাবে দীর্ঘ ১৮ বছর পর নাম পাল্টে দিয়েছিল সৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পালিয়ে গেলেও আজ অবধি প্রতিষ্ঠানের পূর্বের নাম পুনঃস্থাপন না করে গড়িমসি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘ ১৫ মাসেও প্রতিষ্ঠানটির নাম পুনঃস্থাপন না করায় প্রশাসনে সৈরাচারের দুশররা এখনো রয়ে গেছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এলাকাবাসী, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে চাঁপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
জানা যায়, কানাইঘাট উপজেলার ১নং লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের দূর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার উন্নয়নে ১৯৯৬ সালে মুলাগুল এলাকায় এ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০০১ সালে এলাকাবাসীর এক বৈঠকে রেজুলেশনের মাধ্যমে সে অঞ্চলের কৃতি সন্তান বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব বীরমুক্তিযোদ্ধা আবুল হারিছ চৌধুরী’র নামে বিদ্যালয়টির নামকরণ করা হয় “মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি”। ২০০৫ সালে এ নামেই অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হয়। ২০১৭-১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিদ্যালয়ের নবম ও দশম শ্রেণীর একাডেমিক স্বীকৃতির জন্য আবেদন করে বিড়ম্বনায় পড়েন কর্তৃপক্ষ। বিদ্যালয়ের নামের সাথে হারিছ চৌধুরীর নাম সংযুক্ত থাকায় একাডেমিক স্বীকৃতির বদলে জনগুরুত্বপূর্ণ বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা শুরু হয়। এহেন কঠিন পরিস্থিতিতে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর হারিছ চৌধুরী’র নাম বাদ দিয়ে মুলাগুল উচ্চ বিদ্যালয় নামে শিক্ষা বোর্ড থেকে নবম ও দশম শ্রেণীর একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করেন এলাকাবাসী। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকাবাসী তাৎক্ষণিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটক ও বিদ্যালয় ভবনে পূর্বের নাম “মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি” লাগিয়ে দিলেও এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে মুলাগুল উচ্চ বিদ্যালয় নাম রয়ে গেছে। এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চলতি বছরের ২৯ জুন এক সাধারণ সভার মাধ্যমে বর্তমান মুলাগুল উচ্চ বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে পূর্বের নাম মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি পুনঃস্থাপনের জন্য গত ৮ জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেন। এ আবেদনের পর দীর্ঘ চার মাস চলে গেলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি নেই বলে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আফতাব উদ্দিন বলেন-২০১৯ সালে নবম ও দশম শ্রেণীর একাডেমিক স্বীকৃতি লাভ করতে গিয়ে চাঁপে পড়ে বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয়েছিল। গত বছরের ৫ আগস্টের পর আমাদের বিদ্যালয়ের তথ্য চাওয়া হলে আমরা নাম পুনঃস্থাপনের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি। পরবর্তীতে সাধারণ সভার রেজুলেশনের মাধ্যমে পূর্বের নামে নামকরণের জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের কিছুই জানানো হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা সতিপুর গ্রামের আলতাফ হোসেন বলেন-আওয়ামী লীগের আমলে স্থানীয় কতিপয় আওয়ামী দুশররা অন্যায়ভাবে কানাইঘাট-জকিগঞ্জের নয়নমনি জাতীয় নেতা প্রয়াত আবুল হারিছ চৌধুরীর নাম পরিবর্তন করেছিল। বেশ কয়েক মাস পূর্বে আমরা বিদ্যালয়ের পূর্বের নাম ফিরে পেতে সিলেট জেলা প্রশাসক বরাবর আবেদন করেছি। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রশাসনের অগ্রগতি দেখা যাচ্ছেনা। আমরা এলাকাবাসী দ্রুত পূর্বের নাম পুনঃস্থাপনের দাবী জানাচ্ছি।
এলাকার একাধিক ব্যক্তি জানান, চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এলাকার সাধারণ মানুষ আশা করেছিলেন, আগের নামটি দ্রুতই ফিরিয়ে আনা হবে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ বছর পার হয়ে গেলেও সে পরিবর্তনের কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায়নি। প্রতিষ্ঠানের নাম পুনঃস্থাপনের বিষয়ে দুঃখপ্রকাশ করে অনেকেই বলেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রতিষ্ঠানগুলোর ইতিহাস ও পরিচয় ফিরিয়ে আনাটা গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যের অংশ। বিদ্যালয়ের নাম পুনঃস্থাপন শুধু একটি নামবদলের প্রশ্ন নয়, এটি ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।
স্থানীয় বিএনপি নেতৃবৃন্দ বলেন- ‘যদি একটি নাম পরিবর্তনে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১ বছর সময় লেগে যায়, তাহলে বৃহৎ প্রশাসনিক সংস্কার কতটা সময়সাপেক্ষ হবে, তা ভাবতেই আতঙ্ক হয়। তাছাড়া এই নাম পুনঃস্থাপনে তারা আন্তরিক কিনা, তা নিয়ে আমরা যথেষ্ট সন্দিহান। আমরা বর্তমান সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমির নাম পুনঃস্থাপনের কাজটি অনতিবিলম্বে বাস্তবায়নের জোর দাবি জানাচ্ছি। কেননা প্রয়াত আবুল হারিছ চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কানাইঘাটের দূর্গম পাহাড়ি এলাকার শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা অর্জনের সুযোগ তৈরি হয়েছিল। বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেই ইতিহাস সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়ার জন্য মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি সঠিক নামটি অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পুনঃস্থাপন করা উচিত। নেতৃবৃন্দ ইতিহাসের স্বীকৃতি ও মূল্যায়নের জায়গায় যে প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা দেখা যাচ্ছে, তা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথকে বিলম্বিত করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন।
এ প্রসঙ্গে সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে সিলেট জেলা প্রশাসক মোঃ সারওয়ার আলমের সাথে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল দিয়ে পাওয়া যায়নি।
তবে কানাইঘাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তানিয়া আক্তার জানান- উনার উপজেলায় মুলাগুল হারিছ চৌধুরী একাডেমি নামে একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লোকমুখে এ নামে প্রতিষ্ঠানটি পরিচিত হলেও মুলাগুল উচ্চ বিদ্যালয় নামে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠানটির নাম রয়ে গেছে।
তিনি আরও বলেন-প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে আমার নিকট কেউ আবেদন করলে আমি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে ব্যবস্থা নিতাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত আমার নিকট এ বিষয়ে কেউ আবেদন করেননি। ফলে আমি স্বপ্রণোদিত হয়ে এ কাজ করতে পারিনা।
Leave a Reply