সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলা জুড়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করেই উচ্ছ্বাসে মেতে উঠেছিল সীমান্তবর্তী এ জনপদের হিন্দুধর্মাবলম্বী হাজার হাজার শিশু-কিশোর ও নারী-পুরুষ। দশমীর দুপুরে প্রবল ঝড় বৃষ্টি চললেও দেবীর বিদায় লগ্নে সিঁদুর খেলায় ভাঁটা পড়েনি। মণ্ডপের সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন নারী পুরুষ, ছোট বড় সকলের। শাড়ির আঁচলে সিঁদুর মেখে একে অপরকে শুভেচ্ছা জানাতে ব্যস্ত ছিলেন মহিলারা। কোথাও আবার ঢাকের তালে তালে সিঁদুর খেলার সঙ্গে জমে উঠল নাচ গানও। জকিগঞ্জ পৌরসভাসহ উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে আকাশ কালো করে ঝড় বৃষ্টি শুরু হলেও উৎসবের আবহাওয়ায় তাতে ভাটা পড়েনি। স্থানীয় মণ্ডপে একে অপরকে সিঁদুর মেখে বিদায়ের আবেগ ভাগ করে নেন সকলে।
মহিলাদের চোখেমুখে ছিল দেবীকে বিদায় জানানোর বেদনা, আবার পরের বছর “আসছে বছর আবার হবে”-র প্রত্যাশাও। আবহাওয়ার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বাংলার সর্বত্র সিঁদুর খেলায় তৈরি হল রঙিন ও আবেগঘন এক চিত্র, যা প্রমাণ করল বাংলার হিন্দুদের নিকট দুর্গোৎসব কেবল উৎসব নয়, বরং আত্মার সঙ্গে জড়ানো এক অমূল্য অনুভূতি।
বৃহস্পতিবার (১লা অক্টোবর) জকিগঞ্জ পৌরসভার কাস্টমস ঘাটে নির্মিত অস্থায়ী নিরঞ্জন ঘাটে পূর্ণ উদ্দীপনায় পালিত হল বিজয়া দশমী। দুর্গাপূজার সমাপ্তি লগ্নে প্রতিবারের মতোই দেবী দুর্গাকে আবেগঘন বিদায় জানালেন দর্শনার্থীরা। ঐতিহ্য মেনে সর্বত্রই অনুষ্ঠিত হয় ‘ঘট বিসর্জন’ ও ‘সিঁদুর খেলা’।
এদিকে হিন্দুধর্মাবলম্বী এ উৎসবকে ঘিরে ভারত-বাংলার দুই তীরের বসেছিলো ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজারো মানুষের মিলনমেলা। আনন্দে মেতে ওঠে সীমান্ত নদী কুশিয়ারা পাড়ের নানা ধর্ম-বর্ণের হাজারো মানুষ। ঢাকঢোল, কাসর, করতাল, মন্দিরা, বাঁশি এবং শঙ্খ’র ধ্বনিতে মুখরিত হয় গোটা এলাকা। ভারত-বাংলার নদীর দুই তীরে দু-দেশের প্রতিমা বিসর্জন দেখতে অগণিত লোক সমাগম ঘটে। অসংখ্য মানুষের পদচারণয় মুখরিত হয়ে উঠে জকিগঞ্জ শহরের কাষ্টমঘাট ও ভারতের কাষ্টমঘাটস্থ অখন্ড মন্ডলী মন্দিরের আশপাশ এলাকা। কয়েক যুগধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনে এ উৎসব ভারত-বাংলাদেশের দুই তীর এভাবেই চলে আসছে।
বিজয়া দশমীতে পূজার্থীদের শুভেচ্ছা জানাতে বিসর্জন ঘাটে আসেন রাজনীবিদ ও জনপ্রতিনিধিগণের পাশাপাশি উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ কর্মকর্তা, সাংবাদিক, সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দসহ জকিগঞ্জের বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ। প্রতিমা নিরঞ্জন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, ডিবি পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসের ডুবরি দল, আনসার সদস্যরা ছিল সর্তক অবস্থায়। ভারতের করিমগঞ্জেও দেখা গেছে সেখানকার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা।
প্রতিমা বিসর্জন অনুষ্ঠান মঞ্চে উপজেলা পূজা পরিষদের সভাপতি সঞ্জয় চন্দ্র নাথের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রাজস বিশ্বাসের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সনাতন ধর্মালম্বীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন জকিগঞ্জ সার্কেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মফিজুর রহমান, উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভুমি) প্রনয় বিশ্বাস, সিলেট মহানগর বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও মহানগর সেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক সাবেক ছাত্রনেতা ভিপি মাহবুবুল হক চৌধুরী, জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না, পুলিশ পরিদর্শক আদনান, জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন সেলিম, জকিগঞ্জ প্রেসক্লাব সাধারণ সম্পাদক শ্রীকান্ত পাল, জকিগঞ্জ পুজা উদযাপন পরিষদের নেতা হীরালাল বিশ্বাস, বাবুল চন্দ্র নাথ, নিহার রঞ্জন রায়, দুলন রায়, মুক্তলাল বিশ্বাস ও বিজিত রায় প্রমূখ।
এ সময় বক্তারা বলেন, বিশ্ব দরবারে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জল দৃষ্টান্ত বাংলাদেশ। আবহমান কাল থেকে আমাদের দেশের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। সরকার সকল ধর্মের মানুষের অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। জকিগঞ্জ উপজেলায় যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতির বন্ধন রয়েছে। পুরনো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আরও সুদৃঢ় করতে সবাইকে অবদান রাখতে বক্তারা আহবান জানিয়েছেন।
Leave a Reply