একজন মানুষের ছোয়া পেয়ে একটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ চিত্র বদলে যেতে পারে-এ কথার বাস্তব প্রমাণ জকিগঞ্জ সরকারি কলেজ-এর হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ-এর প্রভাষক মোহাম্মদ হোসেন (জামিল)। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, একজন স্বপ্নদ্রষ্টাও। জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে মাত্র ৭ মাস ৩ দিন দায়িত্ব পালন করে তিনি কলেজের শিক্ষার মান, পরিবেশ ও পরিচিতি বদলে দিয়েছেন এক ঐতিহাসিক উচ্চতায়।
জানা যায়, ২০২১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ৩৮তম বিসিএস ক্যাডার হিসেবে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন মোহাম্মদ হোসেন (জামিল)। যোগদানের পর থেকেই কলেজের সামগ্রিক উন্নয়নের চিন্তা মাথায় নিয়ে কাজ শুরু করেন। তখন থেকেই কলেজের ড্রেস কোড ও আইডি কার্ড পরিবর্তনের মতো সাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীদের বিদ্যুৎ কর্মী ভেবে নেওয়ার মতো ড্রেস সিস্টেম পরিবর্তন করে সাদা শার্ট ও কালো প্যান্ট চালু করেন, যা শিক্ষার্থীদের পরিচয়ে আনে শৃঙ্খলা ও মর্যাদা। ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর তিনি জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় কলেজ উন্নয়নের এক নতুন অধ্যায়। শুধু প্রশাসক হিসেবে নয়, শিক্ষক হিসেবেও নিয়মিত ক্লাস নেওয়া, শিক্ষক সংকটে অন্যান্য বিষয়ের ক্লাস করানো ছিল তাঁর নিত্যদিনের কাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর থেকে ২১ এপ্রিল ২০২৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্বপালনকালে তিনি কর্মচারীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ইন-হাউজ ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক সেমিনার আয়োজন, কলেজে প্রথমবারের মতো ক্যান্টিন চালু, কলেজ প্রাঙ্গণে একটি মসজিদ স্থাপন, কম্পিউটার ল্যাব চালু ও লাইব্রেরিতে উন্নত মানের বই সংযোজন, বাংলা বিতর্ক ক্লাব ও ইংরেজি ভাষা ক্লাব গঠন, ড্রেস ও আইডি কার্ড বাধ্যতামূলক করে শৃঙ্খলার পরিচায়ক তৈরি, শিক্ষার্থীদের দ্বারা গঠিত সেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে কলেজ পরিচ্ছন্ন রাখা, পানির ফিল্টার, ডাস্টবিন ও খেলার সামগ্রী সরবরাহ, ১লা বৈশাখ, পূজা ও অন্যান্য উৎসবগুলোকে জাঁকজমকভাবে উদযাপন, শিক্ষার্থীদের ক্লাস উপস্থিতির উপর নাম্বার সংযোজন ও ক্লাস টেস্ট চালু, ছয়তলা একাডেমিক ভবনে শ্রেণিকক্ষ স্থানান্তর, কলেজে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করে নিরাপত্তা জোরদার, সাহিত্য ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজন, জকিগঞ্জ উপজেলা পর্যায়ে বিতর্ক ও বিজ্ঞান মেলায় অংশগ্রহণ এবং পুরস্কার, বন্যার্তদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ কর্মসূচি’র আয়োজন করে অতিতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেন। তিনি এসব কাজের মাধ্যমে অল্প সময়েই কলেজের সার্বিক পরিবেশে একটি ইতিবাচক আমূল পরিবর্তন এনেছেন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক সকলেই এই রূপান্তরের সাক্ষী।
কথা বলে জানা যায়, মোহাম্মদ হোসেন (জামিল) ১৯৯১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মদিন যেমন বিজয় দিবসের একটি গৌরবের দিন, তাঁর জীবনযাত্রাও ঠিক তেমনই গর্বের। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন কিশলয় বিদ্যানিকেতন থেকে। ২০০৮ সালে রাখালগঞ্জ কে.সি. হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ২০১০ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। এরপর তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) থেকে হিসাববিজ্ঞানে বিবিএ ও এমবিএ সম্পন্ন করেন। উচ্চশিক্ষা শেষে ২০১৯ সালে ঢাকায় প্রিমিয়ার ব্যাংকের হেড অফিসে প্রবেশনারী অফিসার হিসেবে যোগ দেন। পরে শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রধান শাখায় ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবেও কর্মরত ছিলেন। কিন্তু ব্যাংক চাকরির স্থায়িত্ব নয়, তাঁর স্বপ্ন ছিল জাতি গঠন। তাই বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে থাকেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি ভালোবাসা থেকে কিছুদিন সিলেট কমার্স কলেজে অতিথি শিক্ষকতা করেন এবং ২০২১ সালে সফলভাবে ৩৮তম বিসিএস ক্যাডার হয়ে জকিগঞ্জ সরকারি কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন।
শিক্ষার্থীরা জানান, মোহাম্মদ হোসেন (জামিল) শুধু একজন সফল প্রশাসক নন, তিনি একদল শিক্ষার্থীর হৃদয়ে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও প্রেরণার নাম। তার নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কলেজ প্রশাসন আজ অনুকরণীয় মডেল।
তিনি প্রমাণ করেছেন- সদিচ্ছা, সৎ উদ্দেশ্য আর নেতৃত্বদানের সাহস থাকলে একটি প্রতিষ্ঠানকে কিভাবে বদলে দেওয়া যায়। জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের ইতিহাসে তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
Leave a Reply