আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে সিলেটজুড়ে বিএনপি দলীয় ধানের শীষ প্রতীকের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা এখন তৎপর। ব্যতিক্রম নয় সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনও। বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী একডজন প্রার্থীর নাম শোনা গেলেও অন্তত পাঁচজন নেতা এই আসনে দলের মনোনয়নে এমপি পদে প্রার্থী হতে এলাকায় সক্রিয় রয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা নির্বাচনী আসনে প্রচারণা চালিয়ে গেলেও দলীয় তেমন কোনো বিরোধ, দ্বন্দ্ব দেখা যায়নি। নেতাকর্মীদের মতে, সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশেই সবাই কাজ করছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি বিএনপি নেতা মামুনুর রশীদের (চাকসু মামুন হিসেবে পরিচিত) দু’টি বক্তব্যকে ঘিরে সরগরম হয়ে ওঠেছে সিলেট-৫ আসনের নির্বাচনী মাঠ। মামুনের বক্তব্যের প্রতিবাদে পাল্টা বক্তব্য দিয়েছেন মনোনয়নপ্রত্যাশী অপর দুই নেতা। তাদের বক্তব্য এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রীতিমতো ভাইরাল।
জানা গেছে, সিলেট-৫ আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী হিসেবে কাজ করছেন সিলেট জেলা বিএনপির সহসভাপতি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন), সিলেট জেলা বিএনপির উপদেষ্টা আশিক উদ্দিন চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহবায়ক জাকির হোসাইন ও সিলেট মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক মাহবুবুল হক চৌধুরী।
গেল বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকেই এসব নেতা নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে আসছেন। কর্মীসভা, প্রচারপত্র বিলি, দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নসহ নানাভাবে তাঁরা এলাকায় কাজ করছেন।
তবে মাস দুয়েক পূর্বে সিলেট জেলা বিএনপির সহসভাপতি মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন) সিলেট-৫ আসনে নিজের প্রার্থীতার বিষয়ে দলের হাইকমান্ডের সিগন্যাল পেয়েছেন এমন বক্তব্যকে ঘিরে শুরু হয়েছে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য। এতে সরগরম হয়ে উঠেছে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের নির্বাচনী মাঠ। চাকসু মামুনের দাবি, দলের উপর মহল থেকে তাঁকে ‘নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে’। সম্প্রতি সিলেট নগরীর কুমারপাড়াস্থ একটি রেস্টুরেন্টের হলরুমে জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভায় মামুনুর রশীদ বলেন, দেশের মুষ্ঠিমেয় কয়েকটি আসনে বিএনপির প্রার্থী চূড়ান্ত হয়ে গেছে। এর মধ্যে সিলেট-৫ আসনও আছে। আগামী নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এ আসনে আপনাদের প্রার্থী নির্বাচন করবেন।
মামুনুর রশীদ বলেন, “কোনো ধরনের ‘যদি’ চলবে না সিলেট-৫ আসনে। আমি ওয়ান টু ওয়ান কথা বলেছি, আমি বারবার জিজ্ঞেস করেছি, অতীতের অভিজ্ঞতার কথা আমি বারবার তুলে ধরেছি। আমাকে নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে এবং আরো সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছেন।”
একইস্থানে কানাইঘাট উপজেলা বিএনপির নেতাকর্মীদের সাথে মতবিনিময় সভা করেন বিএনপি নেতা মামুনুর রশীদ। সেখানে তিনি দাবি করেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাথে তাঁর দেখা ও কথা হয়েছে। তারেক রহমান নাকি তাঁকে ‘ক্লিয়ারলি’ বলেছেন নির্বাচন করার জন্য সার্বিক প্রস্তুতি নিতে, এমন দাবি করেন মামুনুর রশীদ।
মতবিনিময় সভায় জেলা বিএনপির এই নেতা বলেন, “বিভিন্ন ইস্যুতে, একটা বিষয় বাদ নাই যে আমার সাথে কথা বলেন না। সব বিষয়ে কথা বলে উনি (তারেক রহমান) আমাকে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আমি কেন আপনাকে ডেকেছি আপনি কি বুঝতে পেরেছেন?’ আমি বললাম, ‘ঠিক বুঝতে পারি নাই এখন পর্যন্ত।’ আমি জানি উনি কেন আমাকে ডেকেছেন, তারপরও আমাকে বলতে হয়েছে যে আমি বুঝতে পারি নাই কি কারণে আপনি ডেকেছেন। উনি সরাসরি আমাকে উত্তর দিলেন, ‘আপনি এতোদিন কষ্ট করেছেন, এখন নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেন।’ এই কথাটা শুনে স্বাভাবিক কারণেই আমি আমার আবেগ ধরে রাখতে পারিনি।”
মামুনের রশীদের এই বক্তব্য ঘিরে সিলেট-৫ আসনে কয়েক দিন বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যান্য প্রার্থীদের বক্তব্যে নানা আলোচনা-সমালোচনা শোনা যায়। মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যান্য প্রার্থী ও নেতাকর্মীরা চাকসু মামুনের এমন নিশ্চয়তা মূলক বক্তব্য যখন তোলপাড় শুরু করেন। ঠিক তখনি বিএনপির হাইকমান্ড জানিয়েছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কোন আসনে কাকে প্রার্থী করা হবে, সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। কোনো আসনেই কোনো নেতাকে ‘গ্রিন’ সিগন্যাল দেওয়া হয়নি।
বিশেষ করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘কোনও নির্বাচনী এলাকায় কোনও প্রার্থীকে গ্রিন সিগন্যাল বা সবুজ সংকেত দেওয়া হয়নি। প্রত্যাশীদের মধ্যে দলীয় নানা কার্যক্রমে যার পারফরম্যান্স ভালো তাকেই প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করা হবে।’
তবে গেল শনিবার (৪ অক্টোবর) জকিগঞ্জের বীরশ্রী ইউনিয়নে এক উঠান বৈঠকে মামুনুর রশীদের ওপর আরেকটি বক্তব্যকে ঘিরে নতুন করে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। বক্তব্য পাল্টা বক্তব্য এখন বিভিন্ন মঞ্চ থেকে আসতে শুরু করেছে।
ওই বৈঠকে মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের দলে কিছু ভাইয়েরা আছেন, আমার ছোট ভাই সবাই। আমি খুব স্নেহ করি। অসম্ভব স্নেহ করি বলে বিভিন্ন সময়ে ওরা যখন বিপদে পড়েছে, তখন আমি তাদেরকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছি। সেইসব ভাইয়েরা একত্রিত হয়ে জোর চেষ্টা করছেন যেন আমি ইলেকশনে নমিনেশন না পাই। তারা সবাই একত্রিত হয়েছে, নিশ্চয়ই আমার চেয়ে তাদের শক্তি কম। তারা পারছে না কোনোভাবে। আমি বললাম যে, ভাই কেন তোমরা আলাদা আছো? আসো আমরা সবাই মিলে একসাথে কাজ করি।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৭টা বছর আমরা কিভাবে কাটিয়েছি? সবাই মনে রাখবেন। এখন দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসন্ধানী ভাইয়েরা মাশা আল্লাহ কেউ জোটের প্রার্থী হয়ে আসছেন, কেউ দলের প্রার্থী হয়ে। আল্লাহর মেহেরবানি উনারা খুব সুখে শান্তিতে আরামে ছিলেন। কেউ সরকারের সাথে লিয়াজোঁ করে, কেউ বিদেশে বসে অবস্থান করে। এখন মাশা আল্লাহ টাকা পকেটে ভর্তি, এসে আমাদের মানুষজনদের বিব্রত করছেন এবং বিভিন্নভাবে মানুষকে নষ্ট করার চেষ্টা করছেন।’
সম্ভাব্য প্রার্থীদের কেউ কেউ ‘নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ’ করার চেষ্টা করছেন বলেও মন্তব্য করেন মামুন। তিনি বলেন, এবার যদি সিলেট-৫ আসনে বিএনপি উদ্ধার করতে না পারে, তবে জীবনেও পারবে না। অতীতের মতো ‘ভাড়া খাটতে হবে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
মামুনুর রশীদের এমন বক্তব্যে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চলছে নানামুখী আলোচনা ও সমালোচনা।
এদিকে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের কেউ কেউ মামুনের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। গত রোববার (৫ অক্টোবর) জকিগঞ্জ উপজেলার কসকনকপুর ইউনিয়ন বিএনপি আয়োজিত এক কর্মীসভায় বক্তব্য রাখেন সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপির আহবায়ক জাকির হোসাইন ও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু। তাঁরা দুজনেই মামুনুর রশীদের বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান।
সিদ্দিকুর রহমান পাপলু বলেন, সিলেট-৫ আসনে যাতে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থী নিশ্চিত হয়, সেজন্যই তাঁরা একাট্টা হয়েছেন। সেজন্যই তাঁরা কাজ করছেন।
তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, ‘এই একাট্টা হওয়ার পেছনেও যদি কারো অশ্রাব্য আর অশালীন মন্তব্য থাকে, তাকে কি আমরা বিএনপি বলতে পারি? তাকে কি আমরা বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে পারি?’
পাপলু বলেন, লন্ডন থেকে ঢাকা, সিলেট থেকে জকিগঞ্জ, কানাইঘাট সবখানে আমাদের যুদ্ধ চলছে যাতে সিলেট-৫ আসনে ধানের শীষ নিশ্চিত হয়।
তিনি বলেন, যারা ১৭ বছর আওয়ামী লীগের ছত্রচ্ছায়ায় থেকেছে, আমাদের নেতাকর্মীদের আঙ্গুল দিয়ে পুলিশকে দেখিয়েছে, যারা নেতাকর্মীদের লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে ঘরবাড়ি ছাড়া করেছে, বনেজঙ্গলে গিয়ে থাকতে হয়েছে, তাদেরকে বিএনপি স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপির মনোয়ন প্রত্যাশীদের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে এখন অনেকটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা চায়-নিজেদের মধ্যে তর্ক বিতর্ক কিংবা বিশৃংখলা সৃষ্টি না করে বারবার ধানের শীষ থেকে বঞ্চিত জকিগঞ্জ-কানাইঘাট আসনকে বিএনপির যে কোন প্রার্থীকে দিয়ে উদ্ধার আমাদের প্রথম এবং প্রধান লক্ষ হওয়া উচিত।
Leave a Reply