আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনে বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী ডজনখানেক সম্ভাব্য সংসদ সদস্য প্রার্থীকে নিয়ে চলছে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, কৃষকদল, শ্রমিকদল ও সেচ্ছাসেবক দলসহ বিএনপি’র বিভিন্ন অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়ে নিরলস প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। নেতাকর্মীরা নিজের পছন্দের প্রার্থীকে সৎ, যোগ্য ও দলের জন্য ত্যাগী বলেও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছেন। প্রার্থীদের বেশীর ভাগই ছাত্রদল থেকে উঠে আসা বিএনপি’র নিবেদিতপ্রাণ। বিগত আওয়ামী শাসনামলে জেল-জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বেশ ক’জন। একাধিক মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন মাঠে থাকা অনেক প্রার্থী। দলের কঠিন ও দুঃসময়ে তাঁরা নেতাকর্মীদের সব সময় পাঁশে ছিলেন। মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অর্ধেকেই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী। বিগত ১৬ বছর তাঁরা দেশের বাহিরে থাকলেও মামলা ও হয়রানির শিকার দেশের অনেক নেতাকর্মীর পাঁশে ছিলেন বলে দাবী তাদের। প্রবাসী প্রার্থীদের বেশীর ভাগের-ই দলের হাইকমান্ডের সাথে ভালো সু-সম্পর্ক রয়েছে। সেই ভরসা থেকে এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশে অনেকেই মাঠে কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রবাসীরা গত ৫ আগস্টের পর থেকে ঘনঘন দেশে আসছেন এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক সভা-সমাবেশ সহ বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছেন। তবে বিগত ১৬ বছরে মাঠে থাকা প্রার্থীরা এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাননা। নির্বাচন করতে আগ্রহী দেশে অবস্থানরত প্রার্থীরা আছেন ফুরফুরে মেজাজে। এতদিন নির্বাচনের সময় নিয়ে কিছুটা ধোঁশায়া থাকলেও সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সঙ্গে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ঘোষণার পর দেশে অবস্থানরত প্রার্থীরা মাঠে ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তাঁরা জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যা চিহ্নিত করে নেতাকর্মীদের নিয়ে সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন ও প্রশাসনের সাথে মতবিনিময় করছেন। রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, খেলাধুলা ও সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্ভব্য এমপি প্রার্থীরা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও উপস্থিত হচ্ছেন। বিয়ে-শাদী, জানাজা ও শিরনীতেও পাওয়া যাচ্ছে এসব প্রার্থীদের। অনেক প্রার্থীদের ব্যানার, তোরণ, বিলবোর্ড ও ফেস্টুন শোভা পাচ্ছে হাট-বাজার ও রাস্তার মোড়ে মোড়ে। ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়া সরগরম করে রেখেছেন নিজের অনুস্মারী কর্মী সমর্থকরা। গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারেও প্রার্থীদের নিয়ে ভোটারদের মধ্যে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।
জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের পর আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ ও জাতীয় পার্টি রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা হয়ে পড়ায় এ আসনে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে এসেছে বিএনপিসহ কয়েকটি ইসলামী দল। যার ফলে বিএনপি প্রার্থীরা আগামী নির্বাচনে সহজে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার চিন্তা করছেন। আসনটি এবারের নির্বাচনে উদ্ধার করার টার্গেট বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী সম্ভাব্য সকল এমপি প্রার্থীদের। এ আসনে বিএনপি’র প্রায় এক ডজন প্রার্থী মনোনয়ন চাইবেন বলে ধারণা করছেন নেতাকর্মীরা। এখন পর্যন্ত বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন-সিলেট জেলা বিএনপি’র সহ সভাপতি ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক আপ্যয়ন সম্পাদক মামুনুর রশীদ (চাকসু মামুন), সিলেট জেলা বিএনপি’র উপদেষ্টা ও কানাইঘাট উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আশিক উদ্দিন চৌধুরী, সিলেট জেলা বিএনপি’র সহ সভাপতি ও জেলা কৃষক দলের আহবায়ক এবং জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইকবাল আহমদ তাপাদার, সিলেট জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক ও জেলা যুবদলের সাবেক আহবায়ক সিদ্দিকুর রহমান পাপলু, সিলেট মহানগর বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক ও মহানগর সেচ্ছাসেবক দলের আহবায়ক সাবেক ছাত্রনেতা মাহবুবুল হক চৌধুরী (ভিপি মাহবুব), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী সেচ্ছাসেবক দল যুক্তরাজ্য শাখার সাবেক সহ সাংগঠনিক সম্পাদক ও বর্তমান অস্ট্রেলিয়া মহাদেশ সেচ্ছাসেবক দলের সদস্য সচিব সাবেক ছাত্রনেতা ও তরুণ সমাজসেবী জাহিদুর রহমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত বিএনপি’র সভাপতি এম, জাকির হোসেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব প্রয়াত আবুল হারিছ চৌধুরী’র মেয়ে ব্যারিষ্টার সামিরা তানজিন চৌধুরী, যুক্তরাজ্য বিএনপি’র সাবেক সহ সভাপতি প্রফেসর এম. ফরিদ উদ্দিন, যুক্তরাষ্ট্র বিএনপি’র সহ সভাপতি ও জকিগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক আহবায়ক ও সভাপতি শরীফ আহমদ লস্কর ও জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক লুৎফা খানম চৌধুরী স্বপ্না।
প্রাপ্ত সূত্রে জানা যায়, এসব প্রার্থীদের বেশীর ভাগের জকিগঞ্জ-কানাইঘাট বিএনপিতে ছোট বড় নিজস্ব বলয় রয়েছে। বর্তমানে রাজনীতি ও ভোটের মাঠ দখলে নিতে বিএনপি প্রার্থীদের মধ্যে এক ধরণের প্রতিযোগিতা বিরাজমান। মামুনুর রশীদ চাকসু মামুন, আশিক চৌধুরী, ইকবাল আহমদ, সিদ্দিকুর রহমান পাপলু ও মাহবুবুল হক চৌধুরী জকিগঞ্জ-কানাইঘাটের রাজনীতিতে এখন সরব। প্রায় প্রতিদিন বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। পিছিয়ে থাকছেন না প্রবাসী প্রার্থীরাও। প্রবাস থেকে এসে নেতাকর্মীদের নিয়ে শোডাউন, সভা-সমাবেশ, গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ করছেন অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শরীফ লস্কর ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন এক্ষেত্রে অন্যতম। সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রবাসী জাকির হোসেন ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী জাহিদুর রহমান দেশে না আসলেও নিজেদের কর্মী সমর্থকদের চাঙ্গা রাখছেন বিভিন্নভাবে। বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে নেতাকর্মীদের নিয়ে সামাজিক সংগঠন হারিছ চৌধুরী ফাউন্ডেশন করে মাঠে তৎপর রয়েছেন সামিরা তানজিন চৌধুরী। নির্বাচনী এলাকায় অপরিচিত হলেও হঠাৎ মাঠে নেমে আলোচনায় চলে এসেছেন লুৎফা খানম চৌধুরী স্বপ্না।
অপরদিকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি যুক্তরাজ্য প্রবাসী শিল্পপতি ও সমাজসেবী ফাহিম আল ইসহাক চৌধুরীকে নিয়েও হঠাৎ ভোটের মাঠে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্প্রতি ফাহিম আল চৌধুরী ট্রাস্টের মাধ্যমে শিক্ষার উন্নয়ন ও সামাজিক কার্যক্রমের মাধ্যমে তিনি জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে তৎপরতা শুরু করেছেন। যদিও তিনি নির্বাচন করবেন বলে কোন ঘোষণা দেননি, তবুও তাকে নিয়ে ভোটের মাঠে চলছে আলোচনা। অনেকের ধারণা বিএনপি’র হয়ে নির্বাচনে চলে আসতে পারেন ফাহিম আল ইসহাক চৌধুরী।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, সিলেট-৫ আসনটি উদ্ধার করতে বিএনপির অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী এবার মরিয়া হয়ে উঠেছেন। জোটের নামে এবার এ আসন কাউকে ছাড় দিতে নারাজ প্রার্থীরা। বিএনপি নেতাকর্মীরাও চায় এবার বিএনপি’র কোন প্রার্থী এ আসন থেকে নির্বাচনে যেন আসেন। তবে একাধিক প্রার্থী মাঠে শক্ত অবস্থানে থাকার কারণে নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকটা গ্রুপিং চলে এসেছে। একপক্ষ অপর পক্ষকে কৌশলে ঘায়েল করতে প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এনিয়ে মাঝে মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ির মত ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, সিলেট-৫ আসন প্রতিটি সংসদ নির্বাচনে জোটের হিসেব নিকেশে পড়ে বিএনপির প্রার্থী বঞ্চিত হতে হয়। এতে জকিগঞ্জ-কানাইঘাটে বিএনপির অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এবারের নির্বাচনে বিএনপির নেতাকর্মীরা দলের ত্যাগী প্রার্থীকে ধানের শীষে ভোট দিতে চান। যেকোন শরীকদলকে আসন ছেড়ে দিতে নারাজ নেতাকর্মীরা। সাধারণ মানুষ বিএনপির প্রার্থীকে বিজয়ী করতে অধীর আগ্রহ নিয়ে সময় পার করছেন বলে তৃণমূল কর্মীরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু দলীয় গ্রুপিংকে অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগীতা বলে মনে করা হচ্ছে। দলীয়ভাবে প্রার্থী চূড়ান্ত হলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে একমঞ্চে থাকবেন বলে নেতাকর্মীরা মনে করছেন।
এদিকে বিএনপি’র নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ-বর্জনের মধ্যে থাকা বিএনপি আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। বিশেষ করে বিতর্কিতদের বিষয়ে পুরোপুরি নেতিবাচক অবস্থান নিয়েই প্রার্থী মনোনয়নের চিন্তা দলটিতে। দলের জন্য সত্যিকারের ত্যাগী, সৎ ও ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণযোগ্য এবং ভোটের মাঠে জনপ্রিয়দের হাতে ধানের শীষ তুলে দেবে বিএনপি। এক্ষেত্রে ২০০১, ২০০৮ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীদের বর্তমান অবস্থানও পর্যালোচনা করা হবে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপি নির্বাচনের জন্য সবসময় প্রস্তুত। বড় দলে অনেকেই প্রার্থী হতে আগ্রহী থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। দল সবার বিষয়ে খোঁজ-খবর নেবে, মাঠের পরিস্থিতি দেখে একজনকে চূড়ান্ত করবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হবে। দলের হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী এসব নেতার সার্বিক কার্যকলাপ ‘মনিটরিং’ করা হচ্ছে বলে বিএনপি’র একাধিক শীর্ষ নেতা নিশ্চিত করেছেন।
Leave a Reply