সারাদেশের ন্যায় সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে নতুন এক উপদ্রব মোবাইল ফোন আসক্তি। ২০২০ সালে করোনা মহামারীর সময়ে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাসের নামে অভিভাবকদের তুলে দিতে হয়েছে তাদের কোমলমতি ছেলে মেয়েদের হাতে এ এক মরণ নেশা। এ নেশার আসক্তির কারণে কিশোর-কিশোরীরা লেখাপড়ার নাম করে দারুণভাবে ঝুঁকে পড়েছে মোবাইলের বিভিন্ন অ্যাপসভিত্তিক গেমস, পর্নোগ্রাফি ভিডিও, পাবজি, ফ্রি-ফায়ারের মতো মরণঘাতি গেমসের নেশাসহ ইউটিউব, লাইকি, ফেসবুক, টুইটারসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি। পাশাপাশি মোবাইলের অপব্যবহার করে ছোট্ট ছোট্ট কিশোর কিশোরীরা বুঝে না বুঝে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের আসক্তির জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের রয়েছে অন্যতম ভূমিকা। করোনার সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে অনলাইন ভিত্তিক ক্লাস চালু করা হলেও সেই ধারাবাহিকতা এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলমান রয়েছে। বর্তমানে স্কুল-মাদ্রাসায় নিয়মিত ক্লাস হলেও শিক্ষকরা এখনো মোবাইল ফোনের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে নিয়মিত লেখা-পড়া দিয়ে যাচ্ছেন। যার ফলে অভিভাবকদের নিকট থেকে পড়ার অযুহাত দেখিয়ে শিক্ষার্থীরা মোবাইল নিয়ে দীর্ঘ সময় মোবাইল অপব্যবহার করছেন। পড়া-লেখার অযুহাতে ছেলে মেয়েরা মা-বাবার নিকট আবদার করে দিন রাত যে কোন সময় মোবাইল ফোন নিয়ে যাচ্ছে নিজেদের নিকট। আর অভিভাবকরা অতি উৎসাহী হয়ে সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য বুঝে না বুঝেই তুলে দেন নেশা চেয়েও বেশি শক্তিশালী আসক্তির উপকরণ মোবাইল। মোবাইল আসক্তির ভয়াবহ এ প্রবণতায় বিশেষ করে উঠতি বয়সি ছেলে মেয়েরা বর্তমান পরিস্থিতিতে এক বিরাট সংকটকাল অতিক্রম করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জানা যায়, মোবাইল অতিমাত্রায় ব্যবহারের কারণে চোখের জ্যোতি আনুপাতিক হারে কমে যাচ্ছে এবং কানেও কম শোনার প্রবণতা বেঁড়ে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে একজন শিক্ষার্থীর স্বাস্থ্যগত সমস্যা। এর বাহিরে বর্তমানে সময়ের ছেলে মেয়েরা পড়া লেখার অযুহাতে মা-বাবা বা অভিভাবকের নিকট থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে পড়া-লেখার বদলে নোংরামি বেশী করছে। অল্প বয়সে মোবাইল হাতে পেয়ে ছেলে মেয়েরা হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু, ম্যাসেঞ্জার ও ইনস্ট্রাগ্রাম সহ বিভিন্ন মাধ্যমে বুঝে না বুঝে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। পর্ণোগ্রাফি দেখে দেখে নির্লজ্জ হয়ে মেয়ে ছেলেকে এবং ছেলে মেয়েকে নিজের খোলামেলা ছবি ও ভিডিও দিয়ে দিচ্ছে। ভিডিও কলে কাপড়-চোপড় খোলে একে অন্যের সাথে কথা বলছে। যা এখন অনেকটা অহরহ হয়ে পড়েছে। অভিভাবকরা মান সম্মানের ভয়ে এসব নিয়ে মুখ না খুললেও কিছু কিছু ঘটনা যখন নিয়ন্ত্রণে বাহিরে চলে যায়, তখন বিচার-আচার, মামলা-হামলা ও কোর্ট-কাচারী পর্যন্ত গড়ায়। এমন অনেক ঘটনা গত কয়েক বছরে জকিগঞ্জে ঘটেছে। তন্মধ্যে মামলাও হয়েছে বেশ ক’টি।
আসলে বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা বললেই সবার আগে যে প্রযুক্তির কথা আমাদের মাথায় আসে তা হলো স্মার্টফোন। যোগাযোগ মাধ্যমের সর্বাধুনিক সহজ প্রযুক্তি হচ্ছে মোবাইল ফোন। এর বিকল্প এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার এড়িয়ে চলবার উপায়ও নেই। তাই এর ব্যবহার অনিবার্য। তবে অপব্যবহার যেন না হয়, দিনকে দিন যাতে ছেলে মেয়েরা এর প্রতি আসক্তি বা ঝুঁকে না পড়ে, সেদিকে নজর দেওয়া খুবই জরুরি। এর ভয়াবহতা বা আসক্তি থেকে ছেলে মেয়েদের দূরে রাখতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়া-লেখা মোবাইল ফোনে দেয়া বন্ধ করতে হবে। বাসা বাড়িতে অভিভাবকরা শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দিতে হবে আকর্ষণীয় বই, পত্রপত্রিকা ও বিভিন্ন ধরনের ম্যাগাজিন। যোগাযোগ ঘটাতে হবে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। বিনা প্রয়োজনে এর অতিরিক্ত ব্যবহার পরিহার করা বুদ্ধিমানের কাজ। তাই যাতে আমাদের তরুণ সমাজ এর ভয়াবহতায় ধ্বংস না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য অতীব জরুরি। আমাদের পরবর্তী জেনারেশনকে এ ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করতে হলে প্রথমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে মোবাইলে পড়া-লেখা দেয়া বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি সচেতন হতে হবে অভিভাবকদের। প্রয়োজনের বাহিরে এক মিনিটও যাতে ছেলে মেয়েরা মোবাইল ব্যবহার করতে না পারে সে ব্যাপারে অবশ্যই সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখতে হবে।
আমরা আশা করি, জকিগঞ্জের সবধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের মোবাইল ফোনে পড়া-লেখা দেয়া বন্ধ করবেন এবং অভিভাবকরা নিজের ছেলে মেয়েকে মোবাইল ফোন থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করবেন।
Leave a Reply