জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজারের নিরীহ ব্যবসায়ী নুমান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় তিন দিন চলে গেলেও হত্যা রহস্য এখনও উদঘাটন হয়নি! এখন পর্যন্ত বেরিয়ে আসেনি-এর জন্য দায়ী কে বা কারা? কী উদ্দেশ্যেই-বা তাকে হত্যা করা হয়েছে? এর পেছনে কি অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? নাকি পারিবারিক ঝামেলায় তাকে প্রাণ দিতে হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজও খুঁজে পাচ্ছেন না আত্মীয় স্বজন, স্থানীয় এলাকাবাসী, ব্যবসায়ী, এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও। এ ঘটনায় ঘটনায় শুক্রবার (৩ অক্টোবর) রাতে জকিগঞ্জ থানায় ৩০২/২০১/৩৪ ধারায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন নুমান উদ্দিনের বড় মেয়ে সিলেট পার্কভিউ নার্সিং কলেজের বিএসসি নার্সিং চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নি। জকিগঞ্জ থানার মামলা নং-১, তারিখ-০৩/১০/২০২৫ খ্রিস্টাব্দ। মামলায় আসামি হিসাবে কারো নাম উল্লেখ করা না হলেও পুলিশ সন্দেহজনক হিসেবে নুমান উদ্দিনের শ্যালক ও মামলার স্বাক্ষী হানিফ উদ্দিন সুমনকে আটক করেছে। আটক সুমন জকিগঞ্জ উপজেলার ৬নং সুলতানপুর ইউনিয়নের ঘেচুয়া গ্রামের তাহির আলীর ছেলে। সে ২০০৯ সাল থেকে দুলাভাই নুমান উদ্দিনের বাড়িতে থেকে পড়া-লেখা ও পরিবারকে দেখা-শোনা করে আসছে। এ সুবাদে সে বোন জামাইয়ের দীর্ঘ প্রবাস জীবনের বেশ কিছু টাকা পয়সা আত্মসাৎ এবং জায়গা সম্পত্তি নিয়ে যাওয়ার মতো অভিযোগ পেয়েছে পুলিশ। পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে নিহত নুমান উদ্দিনের সাথে শ্যালক হানিফ উদ্দিনের দীর্ঘদিনের বিরোধের বিষয়টি প্রতিয়মাণ হয়েছে। তবে পুলিশের এমন সন্দেহকে উড়িয়ে দিচ্ছেন খোদ মামলার বাদী জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নি। তিনি নিজের মামাকে নিরপরাধ ও নির্দোষ দাবি করে তাকে রক্ষায় প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাদীর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে বেরিয়ে আসছে অসংলগ্নতা। ন্যায়বিচার প্রত্যাশী হয়ে মামলাটি করেননি, বরং মামলা করতে গিয়ে পক্ষপাত ছিল তার। এমন অভিযোগ উঠে আসছে বিভিন্ন মহল থেকে।বাদীর একটি কথার সঙ্গে আরেকটি কথার অসামঞ্জস্যের কারণে সর্বমহলে সন্দেহ ক্রমেই ঘনিভূত হচ্ছে। নুমান উদ্দিনের নিখোঁজ হওয়া, লাশ ধানক্ষেতে পাওয়া, নোমান উদ্দিনের বাড়ি থেকে সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নেয়া, লাশের নিকট থেকে স্ত্রী-সন্তান দূরে থাকা, মামলা দায়েরে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিদের স্বাক্ষী দেয়া সহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষ এখন হত্যার সাথে পরিবার জড়িত বলে দাবী করছে।
জানা যায়, গত বুধবার (১ অক্টোবর) বিকেলে বাড়ির প্রায় একশো গজের কাছাকাছি শায়লা স্মৃতি হাসপাতালের পেছনে একটি ধানক্ষেতে নিখোঁজের দু’দিন পর নোমান উদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। লাশ পাওয়ার পর থেকেই লোকমূখে গুঞ্জন উঠে নোমান উদ্দিনকে স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও শ্যালক সুমন হত্যা করেছে। কারণ হিসাবে বলা হয়, নোমান উদ্দিনের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখান থেকে নোমান উদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত মানুষের পায়ের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে বাড়িতে তাকে হত্যা করে এখানে এনে ফেলা হয়েছে। এমন সন্দেহ যখন এলাকাবাসীর, ঠিক তখনই নিহত নুমান উদ্দিনের বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নির মূখে ভিন্ন কথা। সে জানায়, তাঁর পিতার জমিজমা নিয়ে তাদের পূরাতন বাড়ি শাহজালালপুর গ্রামে বসবাসরত পিতার চাচা’র পরিবারের সাথে বিরোধ রয়েছে। নিখোঁজের পরদিন তাঁর পিতা সিলেট আদালতে এ মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়ে দাবি করে- জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে হয়তো তাঁর পিতাকে হত্যা করা হয়েছে। তবে তার এমন বক্তব্যকে ঘিরে নানা রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। নিজের মা এবং মামাকে বারবার নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টার পাশাপাশি একটি নরমাল মামলার ঘটনায় অতিশয় বয়োবৃদ্ধ একজন লোককে হত্যার ঘটনায় জড়ানোর চেষ্টা করছে। তার এমন অযৌক্তিক কথাকে এলাকার কেউই পাত্তা দিচ্ছে না এবং বিশ্বাসও করছেনা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিহতের একমাত্র ভাই রিয়াজ উদ্দিন বলেন-“আমার ভাইকে উনার স্ত্রী-শ্যালক, মেয়ে, ভাগনা সহ কয়েকজন হত্যা করেছে। নুমান উদ্দিনের বাড়িতে থাকা সিসি ক্যামেরা কেন সরিয়ে ফেলা হয়েছে এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, নুমান উদ্দিনের স্ত্রী ও শ্যালক টাকা পয়সা ও জায়গা জমি আত্মসাৎ করতেই এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন।
নুমান উদ্দিনের মামা মোঃ মঈন উদ্দিন বলেন, কে মেরেছে তা না দেখলেও লোকমুখে সুমনের নাম উঠে আসছে। যা কিছু রটে তার কিছু না কিছু ঘটে বলেও তিনি মনে করেন।
নুমান উদ্দিনের ফুফু বর্তমানে শাহজালালপুর গ্রামের বাসিন্দা সালমা বেগম বলেন, আমি আমার বাবার বাড়ির সম্পত্তির জন্য কোর্টে নুমান উদ্দিন সহ তার ভাই-বোন সবার উপর একটি স্বত্ব মামলা দিয়েছি। এটা নিয়ে আমাদের এমন কোন বিরোধ সৃষ্টি হয়নি যে, আমি আমার ভাইপোকে মেরে ফেলতে হবে।
নুমান উদ্দিনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী রাবেয়া বেগম বলেন, সুমনকে আমাদের পরিবারের দেখা শোনা এবং খরচপাতি করার জন্য আনা হয়েছিল। কিন্তু সে এসে যেভাবে এখানে কর্তৃত্ব সৃষ্টি করে আমাদের উপর জুলুম ও নির্যাতন শুরু করেছিল তা বলার ভাষা নেই। তার নির্যাতনের কারণেই আমরা তিন তলা ফাউন্ডেশনের পাকার বাড়ি ফেলে অন্যত্র টিন দিয়ে ঘরে করে চলে এসেছি। আমাদেরকে সুমন সরিয়ে দিয়ে এখন তাঁর দুলাভাইয়ের সম্পদ নিতে গিয়ে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে বলে আমরা মনে করছি।
কালিগঞ্জ বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি আবুল হোসেন খাঁন জানান, ব্যবসায়ী নুমান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। কালিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা ক্ষোব্ধ। কারা এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তা আমরা দেখিনি। তবে নুমান উদ্দিনের স্ত্রী ও শালাকে নিয়ে পুলিশ গভীরভাবে তদন্ত করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। তিনি একজন ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে আসামীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আহবান জানান।
বৃহত্তর কালিগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানিকপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি জুবায়ের আহমদ জানান, ব্যবসায়ী নুমান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ও শালা জড়িত বলে আমরা মনে করছি। পুলিশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করলে হত্যাকারি ও হত্যার মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে। আমরা নির্মম এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।
জকিগঞ্জ উপজেলা ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি ও ব্যবসায়ী হাকিম মোঃ শিহাব উদ্দিন এ হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে নুমান উদ্দিনের স্ত্রী, শ্যালক ও মেয়েরাও জড়িত বলে মনে করেন। তিনি ভিডিও সাক্ষাৎকারে মেয়ের দেয়া বক্তব্যের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন- নিজের পিতার লাশ রেখে এমন নিষ্ঠুরভাবে মেয়ের কথা বলাকে কেউ স্বাভাবিক মনে করছেন না। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে আসামীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানান।
স্থানীয় এলাকার একাধিক সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি নিহত নুমান উদ্দিনের স্ত্রী ও শ্যলক হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন-পুলিশ গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকারি ও হত্যার রহস্য সহজে বেরিয়ে আসবে। তাঁরা এমন একটি ন্যক্কারজনক হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পুলিশের নিকট অনুরোধ জানান। তাঁরা মনে করেন অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা না হলে বারবার এমন ঘটনা এলাকায় ঘটবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নিহত নুমান উদ্দিনের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নি বলেন, আমি আমার পিতার হত্যার বিচার চাই। আমার মা এবং মামা এ ঘটনায় নির্দোষ। যারা আমাদের পরিবারকে জড়াচ্ছে ওদের মধ্যেই আমার বাবার হত্যাকারীরা রয়েছে। আওয়ামী লীগের সময়ে আমার মামার প্রভাব ছিল। তাই এখন আমার মামার প্রতি অনেকেই ক্ষোব্ধ হয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করছেন। তার বাবা নুমান উদ্দিনের নিকট থেকে বাড়ির জায়গা মামা সুমন কিনেছেন দাবি করে বলেন-মামার সাথে বাবার কোন বিরোধ ছিলনা। ঘরের মধ্যে সিসি ক্যামেরা লাগানো থাকলেও কোন দিন এই ক্যামেরা সচল ছিলনা বলেও তিনি দাবি করেন। নিজেরা মেয়ে মানুষ হওয়ায় ঘটনার পর থানায় লাশের সাথে তারা কেউ থাকেননি। কিন্তু পরের দিন ময়নাতদন্তের সময় তিনি সিলেট গিয়েছেন। তিনি তার বাবার খুনি একজন বিদেশে চলে গেছেন এবং বাকি দু’জন আত্মগোপনে রয়েছেন দাবী করলেও ঘটনার কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা জকিগঞ্জ থানার উপ-পুলিশ পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মোমেন রকি জানান, নিহতের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নির অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা মামলা নিয়েছি। প্রাথমিক তদন্তে মামলার স্বাক্ষী সুমনকে সন্দেহজন মনে হওয়ায় আমরা গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছি। শীগ্রই সুমনকে এক সাপ্তাহের রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করা হবে। এ ঘটনায় পুলিশ সব ধরনের লোভ লালসা ও প্ররোচনার ঊর্ধ্বে থেকে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলেও তিনি জানান।
জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না বলেন, পুলিশ পরিবারের বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা আশাবাদী এ ঘটনার প্রকৃত রহস্য দ্রুত উদঘাটন হবে। অপরাধী যে-ই হবে আমরা তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো।
উল্লেখ্য যে, জকিগঞ্জ উপজেলার ৯নং মানিকপুর ইউনিয়নের পূর্ব মানিকপুর গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে নুমান উদ্দিন প্রায় ৩০ বছর সৌদি আরব প্রবাসে ছিলেন। ২০২১ সালের দিকে দেশে ফিরে জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজারে মুদি ব্যবসা শুরু করেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে নুমান উদ্দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে কালিগঞ্জ বাজারে দোকান খোলে আর বাড়ি ফিরেননি বলে দাবী করেন পরিবারের লোকজন। নিখোঁজের ঘটনায় ওইদিনই পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জকিগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এর দু’দিনের মাথায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি ধানক্ষেতে নুমান উদ্দিনের লাশ দেখতে পান এলাকার লোকজন। পরে পুলিশ এসে লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি ও লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের নিকট হস্তান্তর করেন।
Leave a Reply