বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। শুরুর দিকে যোগাযোগ বা দূরের বন্ধুকে কাছে আনার এক অভূতপূর্ব প্রভাবক হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছিল মাধ্যমটি। কয়েক বছর ধরে গুজব ও অপপ্রচারের কারণে বেশির ভাগ ব্যবহারকারীর কাছে তা অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর বিষয়ে কঠোর আইনের বিধান থাকলেও যথাযথ ব্যবস্থা নেই।
ফেসবুকের পক্ষ থেকে নেই কোনো জবাবদিহি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফেসবুকে ছড়ানো গুজবের বিষয়ে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাংলাদেশের বেলায় তা ভিন্ন।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, বর্তমানে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। এর মধ্যে ফেসবুক ব্যবহার করে পাঁচ কোটির বেশি মানুষ।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, লাইকির ব্যবহার।
মূলধারার গণমাধ্যমে খবর দেখার বদলে অনেকে এখন ঝুঁকে পড়েছে ফেসবুক ও ইউটিউবে। অর্থের লোভে অনেক ফেসবুকার ও ইউটিউবার চমকপ্রদ শিরোনাম দিয়ে স্পর্শকাতর বিষয়ে গুজব ছড়াচ্ছে। সাধারণ পাঠক বা দর্শক সেসব অসত্য কনটেন্ট সরল মনে বিশ্বাস করে বিভ্রান্তিতে পড়ছে।
মূলত ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, লাইকি, টিকটকসহ সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টে ভিউ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সেসব পোস্ট অনেকে জেনে বা না জেনে শেয়ার করছে, যা একসময় ভাইরাল হয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে একদিকে যেমন অনিরাপদ হয়ে উঠছে এই মাধ্যম, তেমনি জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে অনেকে করছে আইনের লঙ্ঘন। জড়িয়ে পড়ছে সাইবার অপরাধে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন আভাজের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের বিভিন্ন গুজব ও অসত্য কনটেন্টের কারণে জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ভুল তথ্যের তীব্রতা সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০ সালে, করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময়। সে সময় ফেসবুকে স্বাস্থ্যবিষয়ক যেসব ভুল তথ্য উঠে এসেছিল, তা মাত্র এক বছরে ৩৮০ কোটি বার দেখা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, করোনা সংকটকালে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুবাদে স্মার্টফোনে বুঁদ হয়ে যায় শিক্ষার্থীরা। অনেকে এটিকে ভালো কাজে ব্যবহার করলেও কেউ কেউ জড়িয়ে যায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। ফেসবুক, টিকটক, লাইকির মতো ইন্টারনেটভিত্তিক বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে যুক্ত হয়ে অপরাধের নানা কৌশল আয়ত্ত করতে থাকে। এমনকি এসব প্ল্যাটফরমে সংঘবদ্ধ হয়ে অপরাধে জড়াতে থাকে অনেক গ্রুপ। বিভিন্ন এলাকায় আগে থেকেই সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা করোনাকালে অনলাইনকেই বেছে নেয় যোগাযোগের বড় মাধ্যম হিসেবে। বর্তমানে তারা আরো বেশি সক্রিয় ও সংঘবদ্ধ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ফেসবুক, টিকটকের মতো ইন্টারনেটভিত্তিক প্ল্যাটফরমে নীরবে গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। ডালপালা গজিয়ে এক পর্যায়ে এই ভার্চুয়াল বিরোধ রূপ নিতে শুরু করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে। পোস্ট বা লাইক-কমেন্টের মতো তুচ্ছ বিষয়ও বড় সহিংসতা হয়ে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে, রাষ্ট্রীয় তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি সামাজিক ও পারিবারিক অনুশাসন জারি রাখা।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এখন তথ্য-প্রযুক্তির সুবাদে সারা বিশ্ব হাতের মুঠোয়। যা পাচ্ছে লুফে নিচ্ছে কিশোররা। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারের জায়গাটা তারা গুলিয়ে ফেলছে। এ জন্য অভিভাবকদের দায়ও কম নয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তাঁরা বলছেন, সন্তানরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কতটুকু সময় ব্যয় করছে, আর স্মার্টফোনটা কী কাজে লাগাচ্ছে, অভিভাবকদের নিয়মিত মনিটর করতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোনে আগের চেয়ে বেশি সময় কাটাচ্ছে। তাই তাদের প্রতি নজরদারি আরো বাড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন তাঁরা।
তবে সচেতন মহলের অনেকেই মনে করেন, এসব গুজব প্রতিরোধে খোদ ফেসবুক কর্তৃপক্ষ মেটাকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। পাশাপাশি দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও গুজবকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া উচিত।
Leave a Reply