সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার প্রাণপ্রবাহ সুরমা ও কুশিয়ারা নদী দিন দিন শুষ্ক হয়ে পড়ছে। একসময় সারা বছর প্রবহমান থাকা এই দুই নদীতে এখন শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রবাহ থাকে না বললেই চলে । কোথাও কোথাও নদীর বুক জেগে উঠছে চর, বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নৌ চলাচল। স্থানীয় জনগণের মতে, বর্তমানে শুষ্ক মৌসুমে এই দুই নদী একদম পানিশূন্য থাকে। বিষয়টি জকিগঞ্জবাসীর জন্য যথারীতি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কুশিয়ারা তীরের বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন, “দেশ স্বাধীনের সময় আমার বয়স ছিল দশ বছর । মনে পড়ে, সেসময় আব্বার সাথে এই কুশিয়ারা নদীতে প্রচূর মাছ ধরতাম। তখন শুষ্ক মৌসুমেও নদী থাকতো পানিভর্তি। লঞ্চ, স্টিমার ও ইঞ্জিন নৌকা চড়ে এদিক-সেদিক বেড়াতে যেতাম। আজ সবই স্মৃতি। স্রোতস্বিনী কুশিয়ারা-সুরমা এখন মৃত-বিরাণভূমি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুরমা–কুশিয়ারা নদীর এমন পরিস্থিতির পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো উজানে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হওয়া, নদীর তলদেশে অতিরিক্ত পলি জমে নাব্যতা হ্রাস, অপরিকল্পিত নদী দখল ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। শুষ্ক মৌসুমে নদীতে ন্যূনতম পরিবেশগত প্রবাহ বজায় না থাকায় নদীর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে পুরো উপজেলায় দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। সুরমা–কুশিয়ারা নির্ভর বহু মানুষ পানীয় জল, সেচ ও গৃহস্থালি কাজে নদীর ওপর নির্ভরশীল। নদীতে পানি কমে যাওয়ায় স্বভাবতই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হয়েছে- যা দীর্ঘমেয়াদে পানির স্তর নেমে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে । সেইসাথে সঙ্গে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ফলে ইতোমধ্যে খাদ্য নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়া নদীর পানি কমে যাওয়ায় মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে মৎস্য সম্পদ। ডিম ছাড়ার মৌসুমে পর্যাপ্ত পানির অভাবে কমে যাচ্ছে দেশি প্রজাতির মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জেলে ও নদীভিত্তিক জীবিকায় যুক্ত মানুষ। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ না থাকায় পানিদূষণ হচ্ছে , কারণ কম পানিতে শিল্প ও নগর বর্জ্য ঘনীভূত হয়ে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করেছে।
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, সুরমা–কুশিয়ারা নদীর নাব্যতা সংকট ও শুষ্ক মৌসুমের জলস্বল্পতা নিয়ে তারা সচেতন। নদীর বিভিন্ন অংশে ড্রেজিং, সেডিমেন্ট ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার আওতায় কাজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত জলস্তর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পরিস্থিতি নজরদারিতে রাখা হচ্ছে বলেও জানান তারা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, ” সীমান্তবর্তী এলাকা ছাড়া সুরমা-কুশিয়ারার বিভিন্ন স্থানে খননের কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে। দুই-এক বছরের মধ্যে এই কাজটি শুরু হবে ইনশাআল্লাহ। ”
বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য শুধু ড্রেজিং নয়, বরং সমন্বিত নদী ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। উজান থেকে ভাটির স্বাভাবিক পানি প্রবাহ বজায় রাখা, নদী দখল ও দূষণ রোধ এবং পরিবেশগত প্রবাহ নিশ্চিত না করা গেলে সুরমা–কুশিয়ারা ভবিষ্যতে আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই দুই নদীর শুষ্ক হয়ে পড়া শুধু পরিবেশগত নয়, বরং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
Leave a Reply