নেশা ও মাদক মানব-সভ্যতার চরম শত্রু। এটা জীবন ও সম্ভাবনাকে নষ্ট করে, শান্তির পরিবারে অশান্তির আগুন প্রজ্জ্বলিত করে এবং সমাজে অনাচার ও অস্থিরতা সৃষ্টি করে। নেশা ও মাদক সভ্যতার চাকা পিছনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। তাই কল্যাণের ধর্ম ইসলামে নেশা ও মাদক সম্পূর্ণ হারাম। মাদক এমনই খারাপ বস্তু যে, উৎপাদন, বিপণন, পরিবেশন ও গ্রহণের যেকোনো পর্যায়ে এর সাথে সংশ্লিষ্ট থাকা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশাপের কারণ। আর এ তো বলাই বাহুল্য যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অভিশাপ যার উপর তার জীবন কখনো শান্তির হতে পারে না। মাদকের সাথে সংশ্লিষ্টতা তো নিষিদ্ধই, যে মজলিসে মদপান করা হয় ঐ মজলিসে উপস্থিত থাকাও নিষিদ্ধ।
মোটকথা, ইসলামে নেশা ও মাদক চরমভাবে ঘৃণিত ও বর্জনীয়। অথচ এ ঘৃণ্য ও বর্জনীয় বস্তরই ব্যাপক বিস্তার ঘটছে ‘সভ্য’যুগের মুসলিম-সমাজে। এর কুরআন-বর্ণিত কুফলও এ সমাজকে ভুগতে হচ্ছে। শত্রুতা হানাহানি, আত্মবিস্মৃতি ও আল্লাহ বিস্মৃতি, সালাত-সিয়াম বিমুখতা, উচ্ছৃঙ্খলা ও উন্মত্ততা, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই ও খুন এখন এ সমাজের সাধারণ প্রবণতা। কোনো কোনো ঘটনা হয়তো আমাদের কিছুটা চঞ্চল করে, কিন্তু এ ধরনের ঘটনা তো ঘটেই চলেছে। এ অভিশাপ থেকে অনেকেই আমরা মুক্তি পেতে চাই। কিন্তু কী উপায় মুক্তির?
এ ক্ষেত্রে বলতে হবে-মুক্তির একমাত্র উপায় ইসলাম। যে সমাজে ইসলামের আলো প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সে সমাজে মাদক ছিল জীবন ও সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরবী সাহিত্যে নেশা ও মাদকের জন্য রয়েছে শতাধিক শব্দ। মাদক ও তার বিভিন্ন অনুষঙ্গের বিবরণ দিয়ে রচিত হয়েছে শত শত পংক্তি। মাদক ছাড়া আরব্য সংস্কৃতি ও আরবীয় অভিজাত্যের কল্পনা করাও সম্ভব ছিল না। অথচ ঐ সমাজ থেকে মাদক শুধু নির্মূলই হল না, চরম ঘৃণিত ও অপবিত্র বস্তু হিসেবে চিহ্নিত হল। আর মাদকাসক্ত ব্যক্তি সমাজের চোখে নেমে এল চরম লাঞ্ছিত, অপমানিত ও দন্ডপ্রাপ্ত আসামীর স্থানে। মাদকের বিষয়ে মদীনা-সমাজের এই আমূল পরিবর্তন ইসলাম ও ইসলামের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এরই অবদান। কিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগ ও জাতির জন্য এ এক আলোকিত দৃষ্টান্ত। কোনো মানব-গোষ্ঠী যদি ইসলামকে যথার্থ ও আন্তরিকভাবে গ্রহণ করে এবং কুরআন-সুন্নাহর বিধানকে সমর্পিত চিত্তে শিরোধার্য করে তাহলে তা তাদের রুচি ও স্বভাব এবং জীবন ও কর্মে কী বিপ্লব আনতে পারে তার অনেক ইতিহাস রয়েছে।
আমাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, প্রচার ও প্রযুক্তির এই যুগে, অর্থ ও ব্যবস্থাপনার সব কিছু সত্ত্বেও কেন আমরা অসহায়? কীসের অভাবে বর্তমান সভ্যতা অনাচার নির্মূলে চরম ব্যর্থ? আমার যদি ধর্ম-বিমুখ বুদ্ধিজীবীগনের ‘প্রত্যাদেশে’ সম্পূর্ণ অভিভূত না হয়ে থাকি তাহলে এ সত্য অনুধাবনে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, অভাব আমাদের কোনো কিছুরই নেই, অভাব শুধু ‘ঈমান’ তথা ভিতরের শক্তির। আর ‘নাহি আনিল মুনকার’ তথা বাইরের শাসনের। এ দুয়ের কারণেই মদীনা-সমাজ ছিল নেশা ও মাদকসহ সকল অনাচার থেকে মুক্ত আর এ দুয়ের অভাবেই প্রযুক্তি ও প্রচারের এই যুগেও আমরা চরম অসহায় ও ব্যর্থ।
এখনও যারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে চলেন তারা এ সভ্যতার বড় বড় ব্যাধি থেকে মুক্ত। কিন্তু এ সভ্যতার বিপরীত প্রবণতার লালন ও বর্ধনই তো বর্তমান যুগের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। সর্বস্তরের জনগণ, বিশেষত তরুণ ও যুবশ্রেণির মাঝে ঈমানী চেতনার পরিবর্তে কুফরী মানসিকতা, আখিরাতমুখী জীবন-বোধের পরিবর্তে ভোগসর্বস্ব ইহজাগতিকতা, কুরআন-সুন্নাহর প্রতি সমর্পণ ও আনুগত্যের পরিবর্তে বিদ্রোহ ও বিরুদ্ধতা তৈরির চেষ্টাই তো ব্যাপকভাবে কার্যকর। আমাদের শিক্ষা-ব্যবস্থা, প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক পরিবেশ সব ক্ষেত্রেই তো এ প্রয়াস আশংকাজনকভাবে লক্ষণীয়। একই সাথে আইন-আদালত ও বিচার বিভাগের অবস্থা তো বলাই বাহুল্য। এরপর যদি এ সমাজের সন্তানেরা বিপথগামী হয়, নেশা ও মাদকে আসক্ত হয়, যিনা ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসে অভ্যস্ত হয় তাহলে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এ তো এ সমাজের নীতি ও কর্মপন্থার স্বাভাবিক ফলাফল। যে শক্তি তাদেরকে এই সকল অনাচার থেকে মুক্ত করতে ও মুক্ত রাখতে পারত সেই শক্তির বিরুদ্ধেই তো সমাজের ‘দায়িত্বশীল’ শ্রেণী যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এরপর শুধু সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক এবং কিছু শপথবাক্য পাঠের অনুশীলন কীভাবে এই ভয়াবহ ব্যাধি থেকে মুক্তি দিবে?
এ কারণে ধর্ম-বিদ্বেষী চক্রকে, বিশেষত মুসলিম জনপদে, আমরা শুধু ধর্মেরই শত্রু মনে করি না, সমাজ ও সভ্যতারও শত্রু মনে করি। সত্যি সত্যি যদি আমরা মাদক থেকে মুক্তি পেতে চাই তাহলে গোড়া থেকে সংস্কার শুরু করতে হবে। আবার আমাদের ইসলামের দিকে ফিরে আসতে হবে, ঈমানী পরিবেশে ঈমানী তারবিয়াত গ্রহণ করতে হবে। তাহলে ইনশাআল্লাহ শুধু মাদক নয় সকল অনাচার থেকেই আমরা মুক্তি পাব। আর মুক্তি তো আমাদের পেতেই হবে। যেহেতু আখিরাত সত্য, জান্নাত ও জাহান্নাম সত্য তাই সকল অনাচার আমাদের ছাড়তেই হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমীন।
Leave a Reply