সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভয়াবহ শিক্ষক সংকটের কারণে শিক্ষার পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। ৫ শতাধিক শিক্ষার্থীর বিপরীতে বর্তমানে মাত্র দুইজন শিক্ষক দিয়ে পুরো শিক্ষা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষক পদ শূন্য থাকায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম হতাশা বিরাজ করছে। গত বছরের এসএসসি পরীক্ষায় ফলাফল বিপর্যয় ঘটেছে। আশঙ্কা রয়েছে, তীব্র শিক্ষকসংকট চলমান থাকলে আসন্ন এসএসসি পরীক্ষাসহ বার্ষিক পরীক্ষায় ফলাফলে চরম বিপর্যয় ঘটবে।
জানা যায়, ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয় একসময় সীমান্ত এলাকার মেয়েদের শিক্ষার আলো ছড়ালেও বর্তমানে তা অনিশ্চয়তার অতলে তলিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ের অনুমোদিত ৯টি পদের মধ্যে ৭টি শূন্য। নেই প্রধান শিক্ষকও। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষকের অভাবে পাঠদান কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ফলে প্রায়ই দু’টি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের একই কক্ষে গাদাগাদি করে বসিয়ে ক্লাস নিতে বাধ্য হচ্ছেন শিক্ষকরা। এতে পাঠদানের মান নষ্ট হচ্ছে, মনোযোগ হারাচ্ছে শিক্ষার্থীরা।
এ নিয়ে বুধবার জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহবুবুর রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে দ্রুত শিক্ষকসংকট নিরসনের দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
অভিযোগ রয়েছে, একের পর এক শিক্ষক বদলি করা হলেও তাদের স্থলাভিষিক্ত কেউ পদায়ন করা হয়নি। বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ওমর ফারুক বলেন, “স্থলাভিষিক্ত কাউকে না দিয়ে বারবার শিক্ষক বদলি করায় এখন প্রায় সব পদ শূন্য। এ অবস্থায় শিক্ষা কার্যক্রম চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে।”
অভিভাবক মুনিম আহমদ বলেন, “৫৪৯ শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষক মাত্র ২ জন। গণিত-বিজ্ঞান পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা গভীরভাবে শঙ্কিত।”
অভিভাবক ইয়াসিন আহমদ লিটন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আমরা এখন অসহায়। সন্তানরা স্কুলে গেলেও পড়াশোনা হচ্ছে না। সরকার যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেয়, অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা ছেড়ে দেবে। মেয়েদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাবে।”
কেছরী গ্রামের শাহীন আহমদ জানান, “আমার দুই মেয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রী। শিক্ষক না থাকায় তাদের পড়াশোনা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। ৯টি পদের মধ্যে ৭টি শূন্য বহু বছর ধরে। গণিত, ইংরেজি, বিজ্ঞান ছাড়া কেবল সামাজিক বিজ্ঞান ও ইসলাম শিক্ষা চলছে। এতে শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ছে।”
শিক্ষার্থীরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। নবম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলে, “গণিত, বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষক নেই। পরীক্ষার প্রস্তুতিতে সমস্যা হচ্ছে। শিক্ষক ছাড়া আমরা দিশেহারা।”
এসএসসি পরীক্ষার্থী ইসরাত জাহান লিমা জানায়, “দুইজন শিক্ষক সব বিষয় পড়ানোর চেষ্টা করেন। এতে কোনো বিষয়ই ঠিকভাবে শেখা সম্ভব হয় না। আবার প্রায় সময় দুই শ্রেণি একসাথে ক্লাস করলে পড়ায় মনোযোগ দেওয়া যায় না।”
অভিভাবক মহল অভিযোগ করেছেন, শিক্ষকদের অভাবে স্কুলে নিয়মিত পাঠদান ব্যাহত হওয়ায় শিক্ষার্থীরা কোচিং ও প্রাইভেট টিউশনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তবে গ্রামের অধিকাংশ পরিবার আর্থিক সংকটের কারণে অতিরিক্ত খরচ বহন করতে পারছে না। এতে শিক্ষার বৈষম্য বাড়ছে এবং দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা ঝরে পড়ার ঝুঁকিতে পড়ছে।
স্থানীয় শিক্ষানুরাগীরা বলছেন, একসময় এই বিদ্যালয় সীমান্ত অঞ্চলের মেয়েদের জন্য আশীর্বাদ ছিল। এখান থেকে পাশ করে অনেক ছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। অথচ আজ একই বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ভেঙে পড়েছে। এক শিক্ষানুরাগী সতর্ক করে বলেন, “যদি দ্রুত শিক্ষক নিয়োগ না হয়, তবে অনেক পরিবার মেয়েদের স্কুলে পাঠানো বন্ধ করে দেবে। এতে বাল্যবিবাহসহ সামাজিক সমস্যা আরও বাড়তে পারে।”
বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান জানান, “শিক্ষক সংকটের বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। আশা করছি দ্রুত সমাধান আসবে।”
অন্যদিকে জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, সংকট নিরসনে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। তবে নিয়োগ কবে হবে সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা নেই।
Leave a Reply