গতকাল সোমবার (১৫ জানুয়ারী) সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলী ছাহেব বাড়ি সংলগ্ন বালাই হাওরে অনুষ্ঠিত হলো আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর ১৬তম ইন্তেকাল বার্ষিকী উপলক্ষে বিশাল ঈসালে সাওয়াব মাহফিল। এতে মুরিদীন-মুহিব্বীনের উদ্দেশ্যে তা’লীম-তরবিয়ত পেশ করেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী উস্তাযুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এ মাহফিল সকাল সাড়ে ১০টায় আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর মাজার যিয়ারতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। এরপর খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, খতমে দালাইলুল খাইরাতের পাশাপাশি স্মৃতিচারণমূলক ও জীবনঘনিষ্ট আলোচনায় অত্যন্ত ভাবগম্ভীর পরিবেশে অতিবাহিত হয় পুরো দিন।
বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহ’র সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী এমপি, মাওলানা আহমদ হাসান চৌধুরী ফুলতলী ও মাওলানা নজমুল হুদা খানের পরিচালনায় মাহফিলে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান পেশ করেন ভারতের উজানডিহির পীর ছাহেব হযরত মাওলানা সায়্যিদ মোস্তাক আহমদ আল মাদানী, সায়্যিদ জুনাইদ আহমদ আল মাদানী, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হযরত আল্লামা নজমুদ্দীন চৌধুরী, মহাখালী গাউসুল আযম মসজিদের খতীব মাওলানা কবি রূহুল আমীন খান, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব মাওলানা শাব্বির আহমদ মোমতাজী, ঢাকা দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদরাসা অধ্যক্ষ মাওলানা আ. খ. ম আবু বকর সিদ্দীক, চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শহীদুল হক প্রমুখ।
আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অভিব্যক্তি প্রকাশ করেন সিলেট-২ (বিশ্বনাথ-বালাগঞ্জ-ওসমানীনগর) আসনের সংসদ সদস্য এবং প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরী, মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, সিলেট-৩ (দক্ষিণ সুরমা-ফেঞ্চুগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব ও জকিগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ্ব লোকমান উদ্দিন চৌধুরী।
মাহফিলে বক্তব্য রাখেন মাওলানা শিহাব উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, মুফতী মাওলানা গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী, হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী, বাংলাদেশ আনজুমানে আল ইসলাহর মহাসচিব অধ্যক্ষ মাওলানা এ.কে.এম মনোওর আলী, ইয়াকুবিয়া হিফযুল কুরআন বোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি হাফিয মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী, জালালপুর জালালিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা জ. উ.ম আব্দুল মুনঈম, সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আবু জাফর নুমান, বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহবুবুর রহমান ফরহাদ, ঢাকা মোহাম্মদপুর গাউসিয়া ফাযিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা ইজহারুল হক, দারুল হাদীস লাতিফিয়া নর্থওয়েস্ট এর প্রিন্সিপাল মাওলানা সালমান আহমদ চৌধুরী, আমেরিকা প্রবাসী বিশিষ্ট আলিমে দ্বীন মাওলানা আবূ আব্দিল্লাহ মো. আইনুল হুদা, মহাখালী কামিল মাদরাসা মুহাদ্দিস মাওলানা মাহবুবুর রহমান, মৌলভীবাজার টাউন কামিল মাদরাসার মুহাদ্দিস মাওলানা মুহিবুর রহমান, রাখালগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা শেহাব উদ্দিন আলীপুরী, মাওলানা আজিজুর রহমান ধনপুরী, মাওলানা আব্দুর রহমান নেজামী, মাওলানা মোরশেদ আলম ছালেহী প্রমুখ।
মাহফিলে উপস্থিত ছিলেন আনজুমানে আল ইসলাহর সহ সভাপতি অধ্যক্ষ মাওলানা ছরওয়ারে জাহান, মাওলানা ফরিদ আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা মঈনুল ইসলাম পারভেজ, মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী, সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজির উদ্দিন পাশা, অর্থ সম্পাদক মাওলানা গুফরান আহমদ চৌধুরী, বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রহীম, সৎপুর দারুল হাদীস কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা ছালেহ আহমদ বেতকোণী, জকিগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মোশাহিদ আহমদ কামালী, সোবহানীঘাট হযরত শাহজালাল দারুচ্ছুন্নাহ ইয়াকুবিয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবূ ছালেহ মুহাম্মদ কুতবুল আলম, বুরাইয়া কামিল মাদরাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা সিরাজুল ইসলাম ফারুকী, বিশ^নাথ কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা নুমান আহমদ, রাখালগঞ্জ সিনিয়র মাদরাসার সাবেক প্রিন্সিপাল মাওলানা হবিবুর রহমান, ছাতক জালালিয়া আলিম মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল আহাদ, ভারতের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান তালুকদার, তালামীযে ইসলামিয়ার সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি আলমগীর হোসেন, হাফিয মাওলানা নজীর আহমদ হেলাল, মাওলানা বেলাল আহমদ, মাওলানা রেদওয়ান আহমদ চৌধুরী, সাবেক সহ সভাপতি মাওলানা হুমায়ূনুর রহমান লেখন, বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মনজুরুল করিম মহসিন, মৌলভীবাজার চেম্বার অব কমার্স এর সহ-সভাপতি সৈয়দ মোজাম্মিল আলী শরীফ, লতিফিয়া দারুল কিরাত সমিতি, উত্তর পূর্বাঞ্চল, আসাম’র সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আনোয়ার উদ্দিন, মাওলানা কাজী আলাউদ্দিন আহমদ, লতিফিয়া কারী সোসাইটি ঢাকা জেলা সভাপতি মাওলানা আবূ সাদেক মুহাম্মদ ইকবাল খন্দকার প্রমুখ।
তা’লিম তরবিয়ত প্রদানকালে আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব ফুলতলী বলেন, আমরা যারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী, হানাফী আমরা যেন ছোটখাটো বিষয়ে পরষ্পরের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি না করি। হযরত শাহ ওলীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.), শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) প্রমুখ এ উপমহাদেশে আহলে সুন্নাতের অনুসরণীয় আলিম। তাদের কিতাবাদি পড়ুন। অনেক ভুল বুঝাবুঝি দূর হয়ে যাবে। তাসাওউফের নামে এ উপমহাদেশে অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিল। শাহ ওলীউল্লাহ (র.) সঠিক পথ বাতলে দিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমে আমাদের সনদ রাসূলুল্লাহ (সা.) পর্যন্ত পৌঁছেছে। আমরা ইয়া রাসূলুল্লাহ বলি, ইস্তিগাছায় বিশ্বাস করি এ কারণে কেউ কেউ আমাদের বিদআতী বলে থাকেন। অথচ হযরত শাহ ওলীউল্লাহ (র.) এর কিতাবে ইস্তিগাছা রয়েছে। তাঁর আতইয়াবুন নিগাম, আল কাউলুল জামিল, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ পড়ুন। তাবলীগী নেসাবের কিতাব ফাযাইলে দরুদ এর মধ্যে যাকারিয়া (র.) আল্লামা জামী (র.) এর শে’র এনেছেন যেখানে ইয়া রাসূলাল্লাহ বলে আহবান রয়েছে। হযরত থানভী (র.) ও তাঁর কিতাবে আরবী শে’র এনেছেন এবং এগুলোর উর্দু তরজমা করেছেন যেখানে ইস্তিগাছা রয়েছে। সুতরাং আমরা যেন পরষ্পর ভুল বুঝাবুঝি থেকে বিরত থাকি।
আল্লামা ফুলতলী (রহ.) এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, কৈশোরের অনেক স্মৃতি আছে। মা-বাবা উদ্বুদ্ধ করেছেন প্রাণপ্রিয় জন্মভূমির পথঘাট, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে যেন অসহায় মানুষের খেদমত করি। তাঁর প্রেরণায় অসহায় মানুষের মৃত্যুর পর তাদের এতীম সন্তানদের কাছে যাই। অনেক ঝুপড়ি ঘরে প্রবেশ করি। সুরমার তীরে ভাঙ্গা ঝুপড়ি ঘরে মাটির উপর চাটাইয়ে বসে যে তৃপ্তি পাই অট্টালিকায় বসে তা পাই না। অনেক দেশে গেছি কিন্তু গ্রাম-বাংলার অসহায় মানুষের পরশে যে প্রশান্তি পেয়েছি তা অতুলনীয়। অসহায় মানুষের সেবার এ আগুন আল্লামা ফুলতলী (র.) বহু হৃদয়ে জ্বালিয়ে গেছেন। এ খেদমত যেন কিয়ামত পর্যন্ত জারি থাকে। আমাদের খেদমতের অনেক প্রজেক্ট রয়েছে যার সব কিছু বলছি না। তবে কেউ মারা গেলে আমার কার্যালয়ের দায়িত্বশীলদেরকে খবর দেবেন।
মাহফিলে সিলেট-৫ (জকিগঞ্জ-কানাইঘাট) আসনের নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী বলেন, বর্তমান সময়ে বঞ্চিত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর লোকের বড় অভাব। ভালো মানুষের দায়িত্ব না নেওয়ার কারণে অনেক মন্দ লোক সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছে। আমরা এগিয়ে না আসায় এই সমাজ যদি নষ্ট হয়ে যায় তবে কি আমরা দায়বদ্ধ হব না? তাই সমাজ নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। মানুষের সুখ-দুঃখে এগিয়ে আসতে হবে। অনৈসলামিক পরিবেশ থেকে মুসলিম সমাজকে দূরে রাখতে হবে। তাসাউফের দীক্ষা হচ্ছে দুস্থ মানবতার পাশে দাঁড়ানো। কেবল মসজিদে বসে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যাবে না। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হতে হবে। সমাজের যেখানে অন্যায় অবিচার আছে তা নিয়ে কথা বলতে হবে। জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলাম। দেশ বিদেশের শুভাকাক্সক্ষী সকলে দুআ, সহযোগিতা ও সমর্থন করেছেন। জকিগঞ্জ কানাইঘাটের মানুষ অনেক পরিশ্রম করেছেন, আমাকে ভোট দিয়ে দুঃখী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিজয় নিশ্চিত করেছেন। আমি সকলের শোকরিয়া আদায় করছি। তবে মনে রাখতে হবে রাজনীতি আমাদের মূল লক্ষ্য নয়। আমাদের মূল লক্ষ্য দ্বীনের খিদমত, সমাজের খিদমত। তাই ঈমান আকীদা রক্ষার পাশাপাশি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।
Leave a Reply