সিলেটের সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। প্রতিদিনই বাড়ছে নানা ধরনের অপরাধ। মানুষের মধ্যে এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা কাজ করছে। জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অপরাধের মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে, যা জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় খুন, ডাকাতি, ধর্ষণ, ছিনতাই, নারী ও শিশু নির্যাতন, মাদক ব্যবসা ও নানা ধরনের অপরাধ নিয়মিতভাবে সংঘটিত হচ্ছে, যা জকিগঞ্জের স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ।
প্রত্যাশা ছিল নতুন সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে, যার প্রভাব গ্রামাঞ্চলে দৃশ্যমান হবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে সরকারের এক বছর পূর্ণ হলেও দিন দিন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। বর্তমানে এসব পরিস্থিতি আইনের শাসনের অভাবকেই নির্দেশ করছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় সরকারকে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতে পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা এ অবস্থা যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে জকিগঞ্জে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির আরো চরম অবনতি ঘটতে পারে, যা সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে।
চলতি আগস্ট মাসের শুরুতে দু’দিনের ব্যবধানে জকিগঞ্জে দু’টি লাশ পাওয়া গেল। গত ২ আগস্ট শনিবার উপজেলার আটগ্রাম এলাকার মাদাননগরে পাওয়া একজন বৃদ্ধের পরিচয় জানা গেলেও গত ৫ আগস্ট মঙ্গলবার উপজেলার এওলাসার এলাকায় পাওয়া যুবকের লাশের এখন পর্যন্ত পরিচয় জানা যায়নি। আটগ্রাম থেকে উদ্ধার করা বৃদ্ধ মোঃ মাহমুদ আলী পার্শ্ববর্তী কানাইঘাট উপজেলার লক্ষীপ্রসাদ পূর্ব ইউনিয়নের বড়চাতল গ্রামের মৃত আব্দুল গফুরের ছেলে। এই দু’জন ব্যক্তিকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়েছেন বলে এলাকাবাসীর ধারণা। এর আগে গত ১৯ জুলাই জকিগঞ্জ থেকে নিখোঁজের ১২দিন পর ভারত থেকে আব্দুল মালিক (৪২) নামে এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত আব্দুল মালিক উপজেলার কসকনকপুর ইউনিয়নের মৌলভীরচক গ্রামের মিরাশী বাড়ির মৃত ইব্রাহিম আলীর ছেলে ছিলেন। এর কিছুদিন আগে গত ৮ জুলাই পাওনা টাকা নিয়ে বিরোধের জের ধরে উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের সমসখানি (খালপার) গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে সুহেল আহমদ (৩২)-কে খুন করে প্রতিপক্ষের লোকজন। বিগত জুলাই মাসে বড় বড় ২/৩ টি ডাকাতির ঘটনাও ঘটেছে। তন্মধ্যে উপজেলার বারঠাকুরী ইউনিয়নের আমলশীদ গ্রামের গোবিন্দ পালের বাড়ি ও উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের খিলোগ্রামের আব্দুল্লাহ আহমদ চৌধুরীর বাড়ি ডাকাতির বিষয়টি ছিল বেশ আলোচিত। এছাড়া প্রতিনিয়ত ছোটখাটো ডাকাতি ও চুরি ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা পেয়ে থাকি। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে গত ২৬ জুলাই উপজেলার বারহাল ইউনিয়নের স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর এক ছাত্রী গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত একজন আসামীও ধরতে পারেনি পুলিশ। এক সময় জকিগঞ্জ ছিনতাই’র ঘটনা কল্পনা করা না গেলেও এখন এমন সব অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ হচ্ছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চল হিসাবে সব সময় এ উপজেলায় মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকসেবীদের আনাগোনা থাকলেও সম্প্রতি সময়ে অতিরিক্ত হারে বেড়ে যাওয়ার সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। মাদক ক্রয়-বিক্রির তুলনায় গ্রেফতার অভিযান তুলনামূলক কম হচ্ছে বলে অভিমত সচেতন মহলের।
তবে এমন অনেক আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির মধ্যেও পুলিশ কিছুটা হলেও ভালো সংবাদ দিচ্ছে। চলতি সাপ্তাহে পুরো সিলেট অভিযান চালিয়ে লুন্ঠিত মালামালসহ ৪ জন ডাকাতকে আটক করতে সক্ষম হয়েছে। এর আগেও আরোও দু’জন ডাকাতকে গ্রেফতার করেছে। মাঝে মধ্যে মাদক উদ্ধার করতেও দেখা যায় পুলিশকে। এছাড়াও অপরাধীদের ধরতে নিয়মিত পুলিশী অভিযান অব্যাহত আছে বলেও জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বারবার জানাচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও জকিগঞ্জের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে অপরাধ দমন ও নিয়ন্ত্রণে যে ধরনের সময়োপযোগী উদ্যোগ প্রয়োজন, তা এখনো পর্যাপ্তভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকাণ্ডও প্রশ্নের মুখে পড়ছে। যখনই কোনো ঘটনা ঘটে তখনই পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা তাৎক্ষণিক অ্যাকশনে যাচ্ছে। তবে অভিযোগ রয়েছে, যে কোন ঘটনায় পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেলে পুলিশের কর্মকাণ্ডও স্থবির হয়ে পড়ে। সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢিলেমির চিত্র জনমানুষের চোখে পরিষ্কার।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, একদিকে অপরাধীরা বিভিন্ন স্থানে নিত্যনতুন অপরাধ সংঘটিত করছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয় ও কলেজে যাওয়ার পথে শঙ্কিত, ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা ও সম্পদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, আর সাধারণ নাগরিকরা নিজ নিজ বাসাবাড়িতেও নিরাপদ বোধ করছেন না। অপরাধীরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে তারা দিনদুপুরে প্রকাশ্যে খুনসহ নানা অপরাধ ঘটাতেও দ্বিধা করছে না। এ অবস্থায় পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয়, তবে জনসাধারণের মধ্যে সরকার এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর আস্থাহীনতা সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে সার্বিক নিরাপত্তা, সামাজিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতি চরম হুমকির মুখে পড়বে।
তাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হলে রাষ্ট্রকে এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে—কাউকে ছাড় নয়, অপরাধের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স। আজ যখন সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীন, তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু অপরাধী ধরাই নয়—একটি ভয়মুক্ত, মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নিশ্চিত করা।
আমরা আশা করি, সরকার জকিগঞ্জের আইন-শৃঙ্খলা উন্নয়নে দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। মানুষের আশা আকাঙ্খার নতুন বাংলাদেশকে শান্ত করে তুলবেন।
Leave a Reply