পবিত্র রমজান মাসকে ঘিরে সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলায় তিন শতাধিক কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু হয়েছে। সহিহ ও শুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন শিক্ষা প্রদানের জন্য উপজেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও স্কুলে পুরো রমজান জুড়ে চলবে তাজবীদের সহিত কুরআন শিক্ষা। এক সাথে এত সংখ্যাক কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেশের আর কোন উপজেলা নেই বলে সংশ্লিষ্টদের দাবী। তাদের মতে, দেশের একমাত্র উপজেলা হচ্ছে সিলেটের জকিগঞ্জ; যেখান থেকে পবিত্র রমজান মাসে সহিহ শুদ্ধভাবে পবিত্র কুরআন শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম প্রথম শুরু হয়েছে। জকিগঞ্জ থেকেই পবিত্র রমজান মাসে পবিত্র কুরআনের আলো ছড়ানো হয় বিশ্বব্যাপী। জকিগঞ্জের আগে দেশের অন্য কোথাও বোর্ড বা ট্রাস্ট ভিত্তিক কিরাত প্রশিক্ষণের প্রাতিষ্ঠানিক কোন ব্যবস্থা ছিলনা বলে দাবী এখানকার আলেম, উলামা, হাফিজ, ক্বারী সহ ধর্মপ্রাণ মানুষের।
জানা যায়, সিলেটের জকিগঞ্জে ১৯৫০ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে দারুল কিরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্টের কার্যক্রম হযরত আল্লামা মোহাম্মদ আব্দুল লতীফ ফুলতলী (রহ.) শুরু করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আজ অবধি ট্রাস্টের প্রধান কেন্দ্র ও দফতর জকিগঞ্জের ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ট্রাস্টের অন্তর্ভুক্ত কেন্দ্র সমূহে জামাতে আউয়াল থেকে খামিছ পর্যন্ত পড়াশোনার সুযোগ থাকলেও কিরাতের সর্বোচ্চ জামাত ছাদিছ পড়ে সনদ নিতে হয় প্রধান কেন্দ্র জকিগঞ্জের ফুলতলী ছাহেব বাড়ি থেকে। বর্তমানে ট্রাস্টের অধীনে দেশ-বিদেশে চার হাজারের মতো কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় ট্রাস্টের ১৪২টি শাখা বা কেন্দ্র রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ট্রাস্টের প্রধান কেন্দ্রের সহকারী নাজিম ও বাদেদেওরাইল ফুলতলী কামিল মাদ্রাসার ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদ হাসান চৌধুরী রায়হান জানান, ট্রাস্টের অধীনে শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় খামিছ ২৭টি, রাবে ৫১টি, ছালিছ ৪১টি, ছানী ১৯টি ও আউয়াল ৪টি কেন্দ্র রয়েছে।
অপরদিকে ১৯৮৫ সালে জকিগঞ্জে শায়খুল কুররা আলহাজ্ব তৈয়বুর রহমানের হাতধরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় মাদানিয়া ক্বোরআন শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ। কওমী ঘরানার আলেম ও ক্বারী ছাহেবদের দ্বারা পরিচালিত এই বোর্ডের অধীনে দেশ-বিদেশে ৩’শ ৭৬টি ক্বোরআন শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় সর্বমোট ৬৩টি কেন্দ্র পারিচালিত হচ্ছে। তন্মধ্যে কিরাতের সর্বোচ্চ জামাত দাওরাহ বা ছাদিছ বোর্ডের প্রধান কেন্দ্র জকিগঞ্জের গঙ্গাজল হাসানিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা ছাড়াও একই উপজেলার জামিয়া মাদানীয়া ক্বাসিমুল উলুম শাহবাগে রয়েছে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা ও সিলেট শহরে পৃথক দু’টি দাওরাহ্ বা ছাদিছ কেন্দ্র রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বোর্ডের প্রধান কেন্দ্রের নাজিম ও বিয়ানীবাজার জামিয়া আঙ্গুরা’র মুহাদ্দিস মাওলানা বিলাল আহমদ ইমরান জানান, বোর্ডের অধীনে শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় খামিছ ১৯টি, রাবে ২০টি, ছালিছ ১৮টি ও ছানী ৬টি কেন্দ্র রয়েছে। তবে বোর্ডের শুধু আউয়াল কেন্দ্র জকিগঞ্জ উপজেলার কোথাও নেই।
অন্যদিকে ২০২২ সালের শেষ দিকে জকিগঞ্জে খলিফায়ে মাদানী আল্লামা শাইখ আব্দুল গফফার মামরখানী (রহ.)-এর নামে শাইখ আবদুল গাফফার রহ. কুরআন শিক্ষা বোর্ড যাত্রা শুরু করে। মাত্র তিন বছরে বোর্ডটি সর্বমোট ৭৫টি কেন্দ্র পরিচালনা করছে। তন্মধ্যে জকিগঞ্জ উপজেলায় সর্বমোট ৩০টি কেন্দ্র পারিচালিত হচ্ছে। কিরাতের সর্বোচ্চ জামাত দাওরাহ বা ছাদিছ বোর্ডের প্রধান কেন্দ্র শুধুমাত্র জকিগঞ্জের মামরখানী ছাহেব বাড়ী সংলগ্ন জামিয়া আল্লামা আবদুল গফফার মামরখানীতে রয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বোর্ডের সেক্রেটারী জেনারেল ও জামিয়া ফয়জেআম মুনশীবাজার-এর নাইবে মুহতামীম মাওলানা মুফতি আব্দুল হান্নান ক্বাসিমী জানান, বোর্ডের অধীনে শুধুমাত্র জকিগঞ্জ উপজেলায় খামিছ ৮টি, রাবে ৮টি, ছালিছ ৭টি, ছানী ৫টি ও আউয়াল ২টি কেন্দ্র রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লেখিত ৩টি বোর্ডের তত্ত্বাবধানে জকিগঞ্জ উপজেলায় ২৩৫টি কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চলমান রয়েছে। তবে এই ৩টি বোর্ডের বাহিরে আরও ৬৮টি কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র জকিগঞ্জে রয়েছে। এসব কেন্দ্র পরিচালনা করছে কুরআন শিক্ষা প্রশিক্ষণ বোর্ড বাংলাদেশ, আঞ্জুমানে তা’লিমুল কুরআন বাংলাদেশ, ইত্তেহাদুল কুররা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড ও আল খলীল কুরআন শিক্ষা বোর্ড বাংলাদেশ।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কোন বোর্ডের অধীন ছাড়াও কিছু কিছু জায়গায় ক্বারী ছাহেবরা নিজ নিজ উদ্যোগে ও ব্যবস্থাপনায় পুরো রমজান জুড়ে কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনা করে যাচ্ছেন।
সব মিলিয়ে পবিত্র রমজান মাসে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জে তিন শতাধিক কিরাত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালু রয়েছে।
বিভিন্ন কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ক্বারী ছাহেবগণ জানান, রমজানে প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৮ ঘটিকা থেকে আম মশ্বকের মাধ্যমে রুটিন অনুযায়ী প্রতিটি কেন্দ্রের দিনের কার্যক্রম শুরু হয়ে চলে পুরো দিনব্যাপী। রুটিন অনুযায়ী প্রতিটি জামাতে প্রতিদিন পৃথক মশ্বক, পবিত্র কুরআন তারতীল, তাদ্ববীর ও হদর অনুযায়ী শিক্ষা প্রদান ও তাজবীদ শিক্ষাদান সহ বিভিন্ন দোয়া দুরুদ শিখানো হয়।
জামিয়া মোহাম্মদিয়া হাড়িকান্দি’র নায়বে মুহতামীম হাফিজ মাওলানা মুফতি হামিদুর রহমান মাদানী বলেন, পবিত্র কুরআন নাযিলের মাস হচ্ছে রমজান। তাই রমজানের সাথে কুরআনের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আর পবিত্র রমজান ও কুরআনের সেই সম্পর্ক ধরে রাখতে যত বেশী কুরআন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে নতুন প্রজন্ম তত উপকৃত হবেন।
তিনি পবিত্র কুরআন সহিহ ও বিশুদ্ধভাবে শিক্ষা গ্রহণ করা ফরজে আইন উল্লেখ করে বলেন, কুরআন নাজিলের এ বরকতি মাসে অল্প সময় মেহনত করলেই কুরআন শিক্ষা করা সম্ভব। সুতরাং দেরি না করে সহিহ ও বিশুদ্ধভাবে কুরআনের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসা সকলের দরকার।
Leave a Reply