ইলমে হাদীসের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক, বহু আলেম ও মুহাদ্দিসগণের উস্তাদ শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ হবিবুর রহমান (রহ.)-এর দ্বিতীয় বার্ষিক ঈসালে সাওয়াব মাহফিল আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি, বুধবার জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রারাই গ্রামের মুহাদ্দিস ছাহেব বাড়ি সংলগ্ন মাঠে অনুষ্ঠিত হবে। বিশাল এ মাহফিলকে ঘিরে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে ঈসালে সাওয়াব মাহফিল বাস্তবায়ন কমিটি। এবারের মাহফিল সফল করতে স্থানীয় আলেম-ওলামা, এলাকাবাসী ও গণমাধ্যমর্মীদের সাথে মতবিনিময় করেছেন লন্ডনস্থ দারুল হাদীস লতিফিয়া’র শিক্ষক ও মুহাদ্দিস ছাহেব (রহ.)-এর বড় ছাহেবজাদা মাওলানা আব্দুল আউয়াল হেলাল। এছাড়াও গত এক সাপ্তাহ থেকে মাহফিল সফলের লক্ষে দফায় দফায় বৈঠক হচ্ছেন।
সূত্র জানায়, আগামীকাল বুধবার সকাল ১০ ঘটিকায় শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ হবিবুর রহমান (রহ.)-এর মাজার জিয়ারতের মাধ্যমে দিনের কার্যক্রম শুরু হবে। এরপর খতমে কুরআন, খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, দালাইলুল খয়রাত শরীফের খতম, যিকির মাহফিল, বিষয় ভিত্তিক বয়ান ও স্মৃতিচারণমৃলক আলোচনা চলবে পরদিন ফজর পর্যন্ত। এ মহতি মাহফিলে প্রধান অতিথি হিসাবে তা’লিম-তরবিয়ত প্রদান করবেন রাহনুমায়ে শারীয়াত ও তরীকত, মুরশিদে বরহক হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী।
আয়োজকগণ জানান, গত দু’বারের চেয়ে এবারের ঈসালে সাওয়াব মাহফিলে বেশী উপস্থিতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই মাহফিলের জন্য মুহাদ্দিস ছাহেব বাড়ি সংলগ্ন মাঠে তৈরি করা হচ্ছে বিশাল প্যান্ডেল ও সুদৃশ্য মঞ্চ। দূর-দূরান্তের মেহমানগণের গাড়ি পার্কিং-এর জন্য নির্ধারিত মাঠ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও আগত সকল মেহমানদের জন্য থাকবে দু’বেলা খাবারের (শিরণী) ব্যবস্থা। মাহফিলকে সুষ্ঠু, সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য শতাধিক সেচ্ছাসেবক কাজ করবেন। আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের প্রশ্রাব-পায়খানা ও অজু-নামাজ সহ প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্নের জন্য স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে প্রস্রাবখানা-টয়লেট ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
ঈসালে সাওয়াব মাহফিলে ফুলতলী বড় ছাহেব কিবলাহ ছাড়াও ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ (রহ.)-এর অন্যান্য ছাহেবজাদাগণ সহ ফুলতলী ছাহেব বাড়ি’র নতুন প্রজন্মের আলেমগণ উপস্থিত থাকবেন বলে আয়োজকগণ জানিয়েছেন। এছাড়াও মাহফিলে দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা পীর-মাশায়েখ, আলেম-ওলামা, ইসলামি চিন্তাবিদ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ সহ সকল শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থাকবেন।
জানা যায়, জকিগঞ্জে রারাই’র মুহাদ্দিস ছাহেব বলে খ্যাত শায়খুল হাদীস আল্লামা মোঃ হবিবুর রহমান (রহ.) ২০২২ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি, রোজ-সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের সময় সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামের নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তিনি যেমন ছিলেন ইলমে শরীয়তের প্রখ্যাত আলিম, তেমনি ছিলেন ইলমে মারিফতেরও শায়খে কামিল। তিনি ছিলেন ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী (রহ.)-এর অন্যতম খলীফা এবং বাংলাদেশ আঞ্জুমানে আল ইসলাহ-এর সাবেক সভাপতি। বর্ণাঢ্য তাঁর জীবন-ইতিহাস। অত্যন্ত মেধাবী এই মনীষী ছাত্র হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, মুহাদ্দিস হিসেবে, প্রিন্সিপাল হিসেবে, মুবাল্লিগ-ওয়ায়েজ হিসেবে, বিভিন্ন দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে, কোর্টের বিচারক হিসেবে প্রখর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। দেশে এবং বিদেশে রয়েছে তাঁর অগনিত গুণগ্রাহী, ভক্ত, অনুগামী ও অনুসারী।
আল্লামা হবিবুর রহমানের জন্ম সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার রারাই গ্রামে ১৯৩৪ সালে। তাঁর পিতা ছিলেন এলাকার প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন মাওলানা মুমতায আলী (রহ.)। পড়ালেখা শুরু করেন তিনি সড়কের বাজার আহমদিয়া মাদরাসায়। এখানে অধ্যায়ন করেন তিনি মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত। এরপর গাছবাড়ী জামিউল উলুম মাদরাসায় পড়ালেখা করেন এবং সেখান থেকে ১৯৫৫ সালে আলিম, ১৯৫৭ সালে ফাযিল ও ১৯৫৯ সালে হাদীস বিভাগে কামিল পাশ করেন। তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান মাদরাসা এডুকেশন বোর্ডের প্রতিটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। ১৯৫৯ সালে তিনি ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় শুরু করেন শিক্ষাকতা। ১৯৬৩ সালে তিনি সৎপুর দারুল হাদীসে প্রধান মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৭৪ ইছামতি দারুল উলুম সিনিয়র মাদরাসায় তাঁকে প্রিন্সিপাল নিযুক্ত করা হয়। সেখানে যোগ্যতা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি চলে যান সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে প্রথমে উম্মুল কুওয়াইন নামক শহরের একটি জামে মসজিদের ইমাম ও খতীব নিযুক্ত হন। সেখানে প্রতিযোগিতামূলক এক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে বিচার বিভাগে যোগদান করেন এবং ১৯৮১ সাল পর্যন্ত উম্মুল কুওয়াইন কোর্টে বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন এবং আবার তাঁর পুরাতন কর্মস্থল ইছামতি মাদরাসায় প্রিন্সিপালের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে অত্যন্ত সুনাম-সুখ্যাতি ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ঐ তারিখেই তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন এ দায়িত্ব থেকে।
মাদরাসার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলেও ইলমে হাদীসের খিদমত থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন হননি কখনও। হাদীসের প্রচার, দরস-তদরীস, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ প্রদান, ওয়াজ নসীহত, তরিকতের তালিম ও তলকীন জারি রেখেছেন আজীবন। এমন কি মৃত্যুসজ্জায় শায়িত অবস্থাতেও তিনি আগ্রহী প্রার্থীদের সবক দিয়েছেন, সনদ দিয়েছেন, নসীহত করেছেন। তাঁর জীবন ছিল দ্বীনের জন্য কুরবান। ইলমী তাজকিরা থেকে তিনি বিরত থাকেননি কখনও। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বসচেতন ও কর্তব্যনিষ্ঠ। তাকে কখনো গাল-গল্প করে সময় নষ্ট করতে দেখা যায়নি। কারো সমালোচনা করতে বা কারো বিরুদ্ধে মন্দবাক্য উচ্চারণ করতে শুনা যায়নি। তিনি ছিলেন উদার, মহৎ ও সবার কল্যানকামী। তিনি যেমন নিজে বেশকিছু দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েম করেছেন তেমনি এসব কাজে অপরকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন, সহযোগিতা করেছেন। তিনি ছিলেন সকল কাজে সুন্নতের পাবন্দ। তিনি বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সিরিয়া, মরক্কো, ভারত, সৌদি আরব সফর করেছেন। সে সব দেশের মশহুর মুহাক্কিক উলামা-মাশায়িখদের সাথে বৈঠক করেছেন, ইলমী আলোচনা করেছেন, হাদীসের সনদ আদান-প্রদান করেছেন।
১৯৯১ সালে তাঁর সম্পাদনায় সিলেট থেকে ‘মাসিক শাহজালাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। বিভিন্ন দ্বীনী কিতাব প্রণয়ন করে গেছেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে আল কাউলুল মাকবুল ফী মীলাদির রাসূল, দোয়ায়ে মাসনুনা ও তেত্রিশ আয়াতের ফযীলত, মাসআলায়ে উশর: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ, দুরূদ শরীফের ফযীলত ও ওযীফা, যিয়ারতে মদীনা মুনাওয়ারা (ফযীলত ও নিয়ম), আসহাবে বদর, ওযীফা, হজ্জ ও যিয়ারত (সংক্ষিপ্ত আহকাম ও নিয়ম), হাদীয়াতুল লাবীব ফী নাবযাতিম মিন সীরাতিন নাবিয়্যিল হাবীব, যাখীরাতুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী ফাদায়িলি সায়্যিদিল মুরসালিন, কানযুল আহাদীসিল আরবাঈন ফী মানাকিবি আহলি বাইতিন নাবিয়্যিল আমীন, তুহফাতুল লাবীব ফী আসানীদিল হাবীব, আত তুহফাতুল লাতীফাহ ফী আহাদীসিল মুসালসালাতিল মুনীফাহ, দালাইলুল খাইরাত (তাহকীক ও বিন্যাস) ও আল হিযবুল আযম (তাহকীক), সীরাতে হাবীবে খোদা সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইত্যাদি। প্রায় ষাট বছর ধরে ইলমে হাদীসের খিদমতে নিরলসভাবে নিয়োজিত ছিলেন এই মনীষী। তিনি হাদীস শরীফের যে দরস দিয়ে গেছেন তা এক অমূল্য সম্পদ। আশার কথা, বিক্ষিপ্ত সে দরসসমূহ সংকলিত করে ‘দরসে হাদীস’ শিরোনামে প্রকাশনা করেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র বিশিষ্ট আলেমেদ্বীন ও সুলেখক মাওলানা আবদুল আউয়াল হেলাল। তিনি মুহাদ্দিস ছাহেব প্রণীত বেশ কিছু আরবি গ্রন্থের সফল অনুবাদও করেছেন। ‘দরসে হাদীসে’র এ খিদমতটিও তিনি চালিয়ে যাবেন বলে আমরা আশা করি। মুহাদ্দিস ছাহেব আজ নেই, তাঁর অনেক কৃতী ও স্মৃতি এখনও বিদ্যমান।
Leave a Reply