সমস্ত প্রশংসা মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর, যিনি মানুষকে মানবতার সেবায় নিয়োজিত হওয়ার তৌফিক দান করেন। মানুষের জীবনে সেবাই শ্রেষ্ঠ ইবাদত- আর যে মানুষ অন্যের জীবন বাঁচাতে চায়, সে নিজেই হয়ে ওঠে আশার আলো।
সিলেটের সীমান্তবর্তী জনপদ জকিগঞ্জ, প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা হলেও, বহু বছর ধরে এখানকার মানুষ ছিলেন আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তখনো হাতুড়ে ডাক্তার, কবিরাজ, ঝাড়ফুঁক- এসবই ছিল ভরসা। কেউ গুরুতর অসুস্থ হলে দূর সিলেট শহরই ছিল একমাত্র গন্তব্য। কিন্তু দুর্বল যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে, অনেকেই পৌঁছাতে পারতেন না। জীবনের শেষ সীমা পেরোনোর আগেই এ বাস্তবতা গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল এক মানুষকে- আর তিনি হলেন-মোস্তফা আহমদ আজাদ। ১৯৮৪ সালে তাঁর পিতা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওসমানী মেডিকেলে চিকিৎসার পর প্রেসক্রিপশন হাতে বাড়ি ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই, ইনজেকশন প্রয়োগের সঠিক ব্যবস্থা না থাকায় তাঁর পিতা মারা যান। সেই শোক এক গভীর অঙ্গীকারে পরিণত হয়-“আমি শিখবো, জানবো, আর নিজের হাতে চিকিৎসা দেবো মানুষকে।”
তখন তিনি ছিলেন কওমী মাদ্রাসার ছাত্র। আধুনিক শিক্ষার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। তবু অদম্য মনোবলে তিনি আর.এম.পি., এল.এম.এ.এফ. ও ফার্মাসিস্ট কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৯২ সাল থেকে তিনি পল্লী চিকিৎসক হিসেবে সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু হৃদয়ের কোণে একটিই স্বপ্ন- নিজ এলাকার মানুষের জন্য একটি হাসপাতাল।
রাবেয়া খাতুন চৌধুরীর স্মৃতিতে এক স্বপ্নের জন্ম:
২০০৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দানবীর সৈয়দ রাগীব আলীর সহধর্মিণী মহিয়সী নারী বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী (লনী) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজায় উপস্থিত ছিলেন মোস্তফা আহমদ আজাদ। দূর থেকে প্রথমবার দেখেছিলেন দানবীর রাগীব আলীকে। সেদিনই তাঁর মনে এক চিন্তা উদয় হয়-“যদি রাবেয়া লনীর স্মৃতিতে তাঁর জন্মভূমি জকিগঞ্জে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা যেত, তবে এলাকার মানুষ সুফল পেতো।”
ইচ্ছে থেকে উদ্যোগ:
২০০৮ সালে তিনি সোনাসার জামেয়া জালালীয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় যোগ দেন এবং মাওলানা রেজাউল করিম জালালীর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা নিয়ে। সেই বছরই সিলেট জালালাবাদ চক্ষু হাসপাতালের সার্জন ডা. এম.এ. মতিনের নেতৃত্বে সোনাসারে বিনামূল্যে “চক্ষু শিবির” অনুষ্ঠিত হয়। শতাধিক রোগী চিকিৎসা ও ওষুধ পান বিনামূল্যে। এটি ছিল সেই স্বপ্নের প্রথম সফল পদক্ষেপ।
এরপর একদিন সিলেটের ডাক–এ প্রকাশিত হয় খবর- মধুবন ব্যবসায়ী সমিতি দানবীর রাগীব আলীকে সংবর্ধনা দেবে। আজাদ সাহেব সুযোগ হারালেন না। জালালী সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে আবেদনপত্র লিখলেন— “জকিগঞ্জের সোনাসারে একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য দানবীরের দৃষ্টি চাই।” পরের বছর ২০০৯ সালের ৩০ আগস্ট তিনি সিলেটের ডাক–এর “মতামত” কলামে প্রকাশ করেন তাঁর আহ্বান— “সোনাসারে রাগীব–রাবেয়া হাসপাতালের একটি শাখা চাই।”
কবিতায় আবেদন, মেয়ে তাহেরার মুখে আশার কথা:
সাড়া না পেয়ে একদিন আজাদ সাহেব তাঁর ছোট মেয়ে তাহেরা আজাদ (তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী)-এর নামে একটি কবিতা লেখেন- “রাবেয়া তুমি চির অম্লান।”
কবিতাটি প্রকাশিত হয় ১২ জানুয়ারি ২০১০ সালে সিলেটের ডাক–এ, এবং সেই লেখাটি দানবীর রাগীব আলীর নজরে আসে। অল্প কিছুদিন পর, রাগীব-রাবেয়া ফাউন্ডেশনের ২৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান “কবি” তাহেরা আজাদ। মঞ্চে কবিতা পাঠ শেষে সে সরাসরি রাগীব আলীর হাতে একটি আবেদনপত্র তুলে দেয়, আর বলে- “দুলাভাই, আপার নামে সোনাসারে একটা হাসপাতাল করে দিন।”
শিশুটির সরল কণ্ঠে উচ্চারিত সেই আবেদন মুহূর্তেই আবেগে ভাসিয়ে দেয় উপস্থিত সবাইকে।
দানবীর মুচকি হেসে বলেন- “তুমি অনেক বড় দাবী নিয়ে এসেছো, কিন্তু ইনশাআল্লাহ তোমার হাসপাতাল হবেই।” সেদিনই যেন স্বপ্নের বীজ বপন হলো।
সংবর্ধনা, অঙ্গীকার ও ভূমিদান:
২০১০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সোনাসার এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দানবীর রাগীব আলীকে দেওয়া হয় গণসংবর্ধনা। সভায় এলাকাবাসীর ঐকান্তিক দাবি- “একটি হাসপাতাল চাই।” আবেগমথিত কণ্ঠে দানবীর বলেন-“আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল তাঁর জন্মভূমির উন্নয়নে কিছু করা। তাঁর আত্মার শান্তির জন্য আমি সোনাসারে হাসপাতাল গড়ব, যদি এলাকাবাসী জমির ব্যবস্থা করে।” এরপর মাওলানা রেজাউল করিম জালালী ২৯ শতক জমি দান করেন হাসপাতালের জন্য। তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন ভূমিদাতা হিসেবে, আর আজাদ সাহেব সেই স্বপ্নের মূল উদ্যোক্তা হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন আজীবন।
ভিত্তিপ্রস্তর থেকে উদ্বোধন
২০১২ সালের ২৩ নভেম্বর সেই স্বপ্ন সত্যি হতে শুরু করল। দানবীর সৈয়দ রাগীব আলী নিজ হাতে স্থাপন করলেন বেগম রাবেয়া খাতুন চৌধুরী জেনারেল হাসপাতাল–এর ভিত্তিপ্রস্তর। আর ২০১৫ সালের ১৭ ডিসেম্বর- উৎসবের ঢল নেমে আসে সোনাসারে। হাজারো মানুষ, রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে ফিতা কেটে উদ্বোধন করেন দানবীর রাগীব আলী। সেদিন জকিগঞ্জবাসীর চোখে অশ্রু ছিল আনন্দের, আর মুখে ছিল কৃতজ্ঞতার প্রার্থনা-“যে হাসপাতালের স্বপ্ন এক সময় অসম্ভব মনে হয়েছিল, তা আজ আমাদের দোরগোড়ায়।”
কৃতজ্ঞতা ও প্রার্থনা:
এই হাসপাতালের মূল নকশা ও প্রয়াসের নেপথ্যে ছিলেন মোস্তফা আহমদ আজাদ- এক সাধারণ মানুষ, যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন অসাধারণ কিছুর।
তাঁর সঙ্গে ছিলেন ভূমিদাতা মাওলানা রেজাউল করিম জালালী, মুক্তিযোদ্ধা সুয়েব আহমদ, ও অসংখ্য সহযোগী। বিশেষ ধন্যবাদ রাগীব–রাবেয়া ফাউন্ডেশনের সচিব মেজর (অব.) শায়খুল হক চৌধুরী, সিলেটের ডাক–এর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক দেওয়ান তৌফিক মজিদ লায়েক, মরহুম সৈয়দ মোস্তফা কামাল, এডভোকেট আবদুল মুকিত অপি, জসীম আল ফাহিম ও পুরো “ডাক পরিবার”-কে।
আজ এই হাসপাতাল পরিচালনা করছেন সুচিকিৎসক ডা. মোয়াজ্জেম ইসলাম। তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে একটি দক্ষ মেডিকেল টিম, যারা নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।
উপসংহার:
রাবেয়া খাতুন চৌধুরী জেনারেল হাসপাতাল আজ শুধু একটি ভবন নয়- এটি এক ত্যাগ, এক প্রার্থনা, এক ভালোবাসার প্রতীক। একজন সন্তানের বাবার মর্মবেদনা থেকে শুরু হয়েছিল যে যাত্রা, তা আজ হাজার মানুষের আশীর্বাদে পরিণত হয়েছে।
আমরা দানবীর সৈয়দ রাগীব আলী সাহেবের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি, রাবেয়া খাতুন চৌধুরী (লনী) আপার আত্মা যেন জান্নাতে শান্তিতে থাকে, আর এই হাসপাতাল যেন যুগে যুগে মানবতার সেবায় আলোকবর্তিকা হয়ে থাকে সেই কামনা করছি।
লেখক: প্রভাষক (হাদীস)- বিয়ানীবাজার কামিল মাদ্রাসা, সূত্র: দৈনিক সিলেটের ডাক ও রাগীব–রাবেয়া জীবনী গ্রন্থ।
Leave a Reply