জকিগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ী ও স্থানীয় পূর্ব মানিকপুর গ্রামের বাসিন্দা নোমান উদ্দিনের লাশ উদ্ধারের ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও হত্যার ঘটনায় ধোঁয়াশা কাটেনি এখনও। এখন পর্যন্ত উদঘাটন হয়নি-এর জন্য দায়ী কে বা কারা? কী উদ্দেশ্যেই-বা তাকে হত্যা করা হয়েছে? এর পেছনে কি অন্য কোনো ষড়যন্ত্র আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে আত্মীয় স্বজন, স্থানীয় এলাকাবাসী, ব্যবসায়ী, এমনকি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও। নির্মম এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন মামলা না হলেও পুলিশ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে স্ত্রী ও শ্যালকসহ প্রায় ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করার খবর পাওয়া গেছে। তবে এলাকাবাসী এ খুনের ঘটনায় নিহত নোমান উদ্দিনের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম ও শ্যালক উপজেলার ঘেচুয়া গ্রামের হানিফ উদ্দিন সুমন জড়িত বলে সন্দেহ করছেন।
জানা যায়, গত বুধবার (১ অক্টোবর) বিকেলে বাড়ির প্রায় একশো গজের ভিতরে শায়লা স্মৃতি হাসপাতালের নিকটে একটি ধানক্ষেতে নিখোঁজের দু’দিন পর নোমান উদ্দিনের লাশ পাওয়া যায়। লাশ পাওয়ার পর থেকেই লোকমূখে গুঞ্জন উঠে নোমান উদ্দিনকে স্ত্রী ও শ্যালক খুন করেছে। কারণ হিসাবে বলা হয়, নোমান উদ্দিনের লাশ যেখানে পাওয়া গেছে সেখান থেকে নোমান উদ্দিনের বাড়ি পর্যন্ত মানুষের পায়ের চিহ্ন রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে বাড়িতে তাকে খুন করে এখানে এনে ফেলা হয়েছে। এমন সন্দেহ যখন এলাকাবাসীর, ঠিক তখনই নিহত নোমান উদ্দিনের বড় মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মুন্নির মূখে ভিন্ন কথা। সে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে জানায়, তাঁর পিতার জমিজমা নিয়ে অন্য একটি বাড়িতে বসবাসরত পিতার চাচা’র পরিবারের সাথে বিরোধ রয়েছে। নিখোঁজের পরদিন তাঁর পিতা সিলেট আদালতে এ মামলার হাজিরা দিতে যাওয়ার কথা ছিল। মেয়ে দাবি করে- জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে হয়তো তাঁর পিতাকে খুন করা হতে পারে। তবে তার এমন বক্তব্যকে ঘিরে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। সে কথার ফাঁকে একাধিকবার ঘটনার সাথে তাঁর ‘মা’ কিংবা ‘মামা’ জড়িত নয় কথাটি বলার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে তার কথার মধ্যে পিতা হারানোর কোন বেদনা বা অনুসূচনা ছিলনা বলে এলাকাবাসীর সন্দেহ আরও ঘনিভূত হয়।
এদিকে সময় যত বাড়ছে সন্দেহের কারণ একে একে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নোমান উদ্দিনের মরদেহ উদ্ধারের পর থানায় রাতভর অ্যাম্বুলেন্সে লাশ রাখা হলেও পরিবারের কোনো সদস্য বা আত্মীয় স্বজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন না বলে লাইভ করে দেখান খোদ অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার। পরিবারের এমন একটি নিষ্ঠুর আচরণে পুরো সিলেট জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। এখন হত্যার সাথে নোমান উদ্দিনের পরিবার জড়িত বলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। এছাড়াও ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় নিহত নোমান উদ্দিনের জানাজা পূর্বে বক্তব্য দিতে গিয়ে নিহতের একমাত্র ভাই রিয়াজ উদ্দিন হাজারো মানুষের সম্মূখে বলেন-“আমার ভাইকে তারা ভাই-বোন (নোমান উদ্দিনের স্ত্রী-শ্যালক) খুন করেছে। এ সময় তিনি নোমান উদ্দিনের বাড়িতে থাকা সিসি ক্যামেরা সরিয়ে ফেলাকেও সন্দেহের অন্যতম কারণ হিসাবে উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নোমান উদ্দিনের আত্মীয় এক মহিলা জকিগঞ্জ সংবাদকে জানান, এ ঘটনার সাথে নোমান উদ্দিনের শ্যালক সুমন জড়িত বলে আমরা মনে করি। পরিবারের দুই পুরুষ সদস্য প্রবাসে থাকায় সে ২০০৮ সালে দেখা শোনা ও খরচপাতি করে দেয়ার জন্য আমাদের বাড়িতে এসেছিল। এরপর বোনের বাড়িতে থেকে বোন জামাইয়ের নিকট থেকে পরিবারের সবাইকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। সুমন অনেকভাবে আমাদের পরিবারকে হয়রানী ও নির্যাতন করেছে। সুমন তাঁর বোন জামাই নোমান উদ্দিনের নিকট থেকে বাড়ির একটি অংশ নিতে চেয়েছিল বলে শুনেছি। নোমান উদ্দিন জায়গা না দেয়ায় এ খুনের ঘটনা ঘটতে পারে। তিনি খুনের সাথে সুমন ও তাঁর বোন (নোমান উদ্দিনের স্ত্রী) সহ ভাগনা তাজুল জড়িত থাকতে পারে বলে মনে করেন। তিনি জানান, লাশ যেদিন পাওয়া গিয়েছে এর আগের রাতে সুমন এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘুরাঘুরি করতে দেখা গেছে। তাদের ধারণা লাশ কোথায় ফেলবে সেই জায়গা তারা খুজছিলেন। শাহজালালপুর গ্রামের পুরাতন বাড়ি এবং নোমান উদ্দিনের ছোট ভাইয়ের বাড়ির নিকট সুমনকে ঘুরাঘুরি করতে দেখেছেন এলাকার লোকজন। বাড়ির সিসি ফুটেজ বের করলে সবকিছু পরিস্কার হতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।
জানতে চাইলে কালিগঞ্জ বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা বিএনপির সহ সভাপতি আবুল হোসেন খাঁন জকিগঞ্জ সংবাদকে জানান, ব্যবসায়ী নোমান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় আমরা মর্মাহত। কালিগঞ্জ বাজারের ব্যবসায়ীরা ক্ষোব্ধ। কারা এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত তা আমরা দেখিনি। তবে নোমান উদ্দিনের স্ত্রী ও শালাকে নিয়ে পুলিশ গভীরভাবে তদন্ত করলে বিষয়টি পরিস্কার হবে। তিনি একজন ব্যবসায়ী হত্যার ঘটনায় উ’দ্বে’গ প্রকাশ করে অবিলম্বে আসামীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার আহবান জানান।
বৃহত্তর কালিগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও মানিকপুর ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি জুবায়ের আহমদ জকিগঞ্জ সংবাদকে জানান, ব্যবসায়ী নোমান উদ্দিন হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী ও শালা জড়িত বলে আমরা মনে করছি। পুলিশ গুরুত্বসহকারে তদন্ত করলে হত্যাকারি ও হত্যার মূল রহস্য বেরিয়ে আসবে। আমরা নির্মম এ হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু বিচার চাই।
জকিগঞ্জ উপজেলা ইসলামী আন্দোলনের সভাপতি ও ব্যবসায়ী হাকিম মোঃ শিহাব উদ্দিন এ হত্যাকান্ডের ঘটনার সাথে নোমান উদ্দিনের স্ত্রী, শ্যালক ও মেয়েরাও জড়িত বলে মনে করেন। তিনি ভিডিও সাক্ষাৎকারে মেয়ের দেয়া বক্তব্যের বিষয়টি উল্লেখ করে জকিগঞ্জ সংবাদকে বলেন- নিজের পিতার লা-শ রেখে এমন নিষ্ঠুরভাবে মেয়ের কথা বলাকে কেউ স্বাভাবিক মনে করছেন না। তিনি এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে আসামীদের চিহ্নিত করে অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবী জানান।
স্থানীয় এলাকার একাধিক সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধি নি-হ-ত নোমান উদ্দিনের স্ত্রী ও শ্যলক হত্যার সাথে জড়িত থাকার সন্দেহ প্রকাশ করে জকিগঞ্জ সংবাদকে বলেন-পুলিশ গভীরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকারি ও হত্যার রহস্য সহজে বেরিয়ে আসবে। তাঁরা এমন একটি ন্যক্কারজনক হত্যাকান্ডের বিচার চেয়ে অবিলম্বে দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য পুলিশের নিকট অনুরোধ জানান। তাঁরা মনে করেন অপরাধীদের চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা না হলে বারবার এমন ঘটনা এলাকায় ঘটবে।
এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে জকিগঞ্জ সংবাদ নিহত নোমান উদ্দিনের স্ত্রীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পায়নি। অপরদিকে শ্যালক হানিফ উদ্দিন সুমনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল দিয়ে মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
জকিগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম মুন্না জকিগঞ্জ সংবাদকে জানান, “ঘটনার পর থেকে নিহতের স্ত্রী, সন্তান, শ্যালক ও কয়েকজন নিকটাত্মীয়সহ অন্তত ১৫ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তদন্তে এখনো প্রকাশ করার মতো কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এখন পযর্ন্ত এ ঘটনায় কোন মামলা হয়নি। তবে পুলিশ এ ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটনে তৎপর রয়েছে।
উল্লেখ্য যে, জকিগঞ্জ উপজেলার ৯নং মানিকপুর ইউনিয়নের পূর্ব মানিকপুর গ্রামের মৃত আব্দুল জব্বারের ছেলে নোমান উদ্দিন প্রায় ২০ বছর সৌদি আরব প্রবাসে ছিলেন। গত ২/৩ বছর আগে দেশে ফিরে কালিগঞ্জ বাজারে মুদি ব্যবসা শুরু করেন। গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টার দিকে নোমান উদ্দিন বাড়ি থেকে বের হয়ে কালিগঞ্জ বাজারে দোকান খোলে আর বাড়ি ফিরেননি বলে দাবী করেন পরিবারের লোকজন। নিখোঁজের ঘটনায় ওইদিনই পরিবারের পক্ষ থেকে স্ত্রী মনোয়ারা বেগম জকিগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। এর দু’দিনের মাথায় বাড়ির পার্শ্ববর্তী একটি ধান ক্ষেতে নোমান উদ্দিনের লাশ দেখতে পান এলাকার লোকজন।
Leave a Reply