জকিগঞ্জ উপজেলার ৩নং কাজলসার ইউনিয়ন-এর অন্তর্গত চৌধুরী বাজারের পাঁশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুলনদী মৎস্য অভয়াশ্রমে অবাধে মাছ শিকারের খবর পাওয়া গেছে। মৎস্য অধিদপ্তর এ বিষয়ে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা না নেওয়াতে প্রকাশ্যে দিনের আলোতেই মাছ শিকারের নামে হরিলুট হয়েছে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকার বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ। এমনটাই অভিযোগ এলাকাবাসী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সহ সচেতন মহলের।
এলাকার লোকজন জানান, গত ১৬, ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবার এই তিন দিনে প্রায় ৮/১০টি গ্রামের শতশত মানুষ ঠেলাজাল, খাড়াজাল, ফাঁসজাল ও পলো দিয়ে প্রায় প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকার মাছ লুটপাট করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলার একমাত্র সরকারি মৎস্য অভায়াশ্রমে এমন লুটপাটের ঘটনায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
তাদের মতে, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা’র খামখেয়ালী ও অবহেলার কারণে একটি সরকারি মৎস্য অভায়াশ্রমে একাধারে ৩ দিন উৎসবমূখর পরিবেশে শতশত মানুষ দেশীয় প্রজাতির মাছ শিকার করতে সক্ষম হয়েছে। এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বারবার উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ফলে সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ অনেকটা ভেস্তে গিয়েছে।
জানা যায়, সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা জকিগঞ্জবাসীর ঐতিহ্য ছিল ‘মাছ’। এক সময় জকিগঞ্জের খালে-বিলে প্রচুর দেশি মাছ পাওয়া যেতো। আর সারা বছর-ই এসব মাছে চাহিদা মিটাতো জকিগঞ্জবাসী। জকিগঞ্জের তখনকার প্রচলিত প্রবাদ’ই ছিল- “মাছ, বাঁশ, সুপারী, জকিগঞ্জের বেটাগিরি, মাছ, সুপারী, ধান, জকিগঞ্জের প্রাণ”। কিন্তু কালের বিবর্তনে মাছের এই ঐতিহ্য হারিয়ে যেতে শুরু করেছিল। জকিগঞ্জের খাল, বিল, নদী, নালা ও হাওর-বাওরে পানি না থাকায় এবং খাল-বিল লিজ দেয়ায় দেশীয় প্রজাতির মাছ অনেকটা বিলুপ্ত হতে শুরু করেছিল।
এমনি প্রেক্ষাপটে বিপন্ন প্রায় মাছের প্রজাতি সংরক্ষণ, অবাধ বিচরণ, প্রজনন, জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৪ সালে সরকারি উদ্যোগে জকিগঞ্জ উপজেলার ৩নং কাজলসার ইউনিয়ন-এর চৌধুরী বাজার সংলগ্ন কুলনদীতে মৎস্য অভায়াশ্রম গড়ে তোলা হয়। যার ফলে এ অভায়াশ্রমে দেশীয় মাছের একটা আশ্রয় হয়েছিল। সময়ের ব্যবধানে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল অনেক দেশীয় প্রজাতির মাছ। পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির মাছের উৎপাদনও বেড়েছিল অনেক। নতুন করে দেশি বিভিন্ন মাছের দেখা মিলেছিল জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে।
স্থানীয়রা জানান, কুলনদী মৎস্য অভায়াশ্রম শুরু’র পর থেকে বেশ কয়েক বছর জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দের নিয়ে পরিচালিত একটি কমিটি খুবই সুশৃঙ্খলভাবে কুলনদী মৎস্য অভায়াশ্রমটি পরিচালনা করে আসছিলেন। কিন্তু বিগত দুই বছরের অধিক সময় থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার অযুহাত দেখিয়ে অভায়াশ্রম পরিচালনা কমিটির সকল দায়িত্বশীল ও সদস্যবৃন্দ এক সাথে লিখতভাবে অব্যাহতি নেন। এরপর থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ মৎস্য অভায়াশ্রমটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়ে। তদারকি কমিয়ে দায়সারাভাবে চলতে শুরু করে উপজেলা মৎস অধিদপ্তর। দীর্ঘ এই সময়ে অভায়াশ্রমটি পরিচালনার জন্য পূরাতন কমিটিকে সক্রিয় করা কিংবা নতুন কমিটি গঠন না করায় ধীরে ধীরে মৎস্য অভায়াশ্রমের মাছ লুটপাট শুরু হয়। প্রথম দিকে কতিপয় প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় রাতের আধারে অভায়াশ্রমের ভিতরে থাকা গর্ত সেচ করে মাছ লুটপাট চললেও সময়ের ব্যবধানে ওরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে সুযোগ বুঝে দিনের বেলা পানিতে লুকিয়ে লুকিয়ে মাছ ধরতে শুরু করে। সর্বশেষ বিগত বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবার দিনে এবং রাতে প্রকাশ্যে বিভিন্ন এলাকার কয়েকশত মানুষ অভায়াশ্রম থেকে প্রায় ২০ লক্ষাধিক টাকার মাছ ধরে নিয়ে যায়। দীর্ঘ এই তিন দিনে একটি বারের জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসার আবু তাহের চৌধুরী সরেজমিনে আসেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে সরকারী মৎস্য অভায়াশ্রম থেকে মাছ লুটপাটের খবর পেয়ে একাধিকবার জকিগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসলেও কাউকে আটক করতে পারেনি।
বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা মৎস্য অফিসার আবু তাহের চৌধুরী বলেন, কুলনদী মৎস্য অভায়াশ্রমে স্থানীয় লোকজন মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়েছি। সেখানে আমাদের সরকারি কোনো পাহাড়াদার নেই। খবর পেয়ে আমাদের লোকজন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সে সময় কাউকে পাওয়া যায়নি।
জকিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুমী আক্তার বলেন, মাছ লুটের খবর পেয়ে থানা পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছি। তারা যাওয়ার পরে কাউকে পায়নি। অভিযুক্তদের চিহ্নিত করতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সিলেট জেলা মৎস্য অফিসার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি উপজেলা মৎস্য অফিসার ও উপজেলা প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলবো।
Leave a Reply